আমরা যখন ঘরবন্দি, নদীচোরেরা তখন দ্বিগুণ উৎসাহে বেরিয়ে পড়েনি তো? সন্দেহটা সপ্তাহ কয়েক আগেই জেগেছিল। হাঁসফাঁস করতে থাকা প্রকৃতি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে খানিকটা দম ফেলার সুযোগ পাচ্ছে- এমন একটি আপাত স্বস্তির কথা লিখতে গিয়ে। দক্ষিণ আমেরিকায় যখন পাচারকারীরা 'লকডাউন' পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আমাজনে বৃক্ষ ও বন্যপ্রাণী নিধন চালিয়ে যাচ্ছিল, আফ্রিকায় যখন হাতি হত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল; তখন বাংলাদেশে নদীখেকোরা কী এমন 'মহাপুরুষ' যে, করোনার কারণে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? যেমন আমার সন্দেহ মূলক প্রমাণ করতেই বন্ধু ও সহযোদ্ধা, রিভারাইন পিপলের পরিচালক এবং রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ তার ফেসবুক ওয়ালে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন এ মাসের গোড়ার দিকে। কুড়িগ্রামের রাজারহাটে তিস্তা নদীতে করোনাকালেও বালু উত্তোলন চলছে। তুহিন ভাই লিখেছেন- 'রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার কালিরহাট এলাকায় তিস্তা নদীতে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন। আসছে বর্ষায় কালিরহাট বাজারসহ ওই এলাকা সম্পূর্ণ ভাঙনের আশঙ্কা। করোনা দুর্যোগে কি 'বালুসন্ত্রাসীরা' কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে?'

কেবল রাজারহাট নয়, গোটা দেশে বালুসন্ত্রাসীরা কী করছে? বিষয়টি বোঝার জন্য একটা চকিত সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। ফলাফল দেখে নিছক উদ্বিগ্ন হওয়ার ব্যাপার নয়। এই করোনাকালে আমাদের নদীগুলো কীভাবে আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে, তার একটি ভয়াবহ ও বীভৎস চিত্র উঠে এসেছে। পেশাসূত্রে আমি যেহেতু মতামত সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত, কিছু শব্দ আমরা বরাবর ছেঁটে ফেলি। যেমন এর একটি হচ্ছে 'প্রতিনিয়ত' কোনো অনিয়ম ঘটে চলা। আমরা অনেক সময় কৌতুক করে বলে থাকি- কোনো কোনো কাজ বা অকাজই আসলে প্রতিনিয়ত করা সম্ভব নয়। অন্তত খাওয়া বা ঘুমানোর জন্য হলেও সংশ্নিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিরতি দেওয়ার কথা। কিন্তু স্বচালিত এই সমীক্ষা দেখে মনে হচ্ছে- মতামত সম্পাদনার এই সূত্র বালুচোরাদের কাছে অচল। তারা প্রকৃত অর্থেই প্রতিনিয়ত দেশের কোথাও না কোথাও এভাবে নদীর বুক খুঁড়ে চলছে।

দেখলাম, এপ্রিল মাসজুড়ে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও থেকে বালু উত্তোলনের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। শুধু এপ্রিলের ১১ তারিখ ও ১৪ তারিখ বালু উত্তোলনের সংবাদ নেই। এপ্রিলের ১৪ তারিখ ছিল বাংলা নববর্ষ। 'বেনিফিট অব ডাউট' বা সন্দেহের সুবিধা দেওয়াই যেতে পারে যে, নববর্ষ উপলক্ষে বালু তোলায় ক্ষান্ত দিয়েছিল নদীখেকোরা। একই কথা বলা চলে ১১ তারিখ নিয়েও। কিন্তু প্রয়াত গায়ক সুবীর নন্দীর কণ্ঠের সঙ্গে মিলিয়ে বলা যায়- কাগজের পাতা ভরে প্রতিদিন শত খবর আসা সত্ত্বেও জীবনপাতার অনেক খবর অগোচরে রয়ে যায়। হতে পারে, বাংলা নববর্ষের দিন বালুসন্ত্রাসীরা ঠিকই তাদের অপকর্ম চালিয়ে গেছে, খবরে আসেনি।

দেখা গেছে, একই দিনে একাধিক এলাকার খবর এসেছে একাধিক পত্রিকায়। এর মানে এই নয় যে, ওই দিন কেবল একটি বা দুটি এলাকাতেই বালু তোলা হয়েছে। এ ধরনের সব খবর আমার চোখে পড়ারও কারণ নেই। প্রকৃত চিত্র নিশ্চিতভাবেই আরও বড়। যেমন ১২ এপ্রিল কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার 'রাজী' নদীতে বালু উত্তোলনের খবর। এই নদীর নামই বা আমরা কতজন জানি? সেখানে বালুসন্ত্রাসীদের তৎপরতার খবর দূরে থাক। যেমন ২৮ এপ্রিল বিডিসিএন নামে একটি নিউজ পোর্টালে প্রকাশ হয়েছিল, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে বালু উত্তোলনের চিত্র। 'ফেকামারা আড়িয়াল খাঁ' নদীতে। দেশে দুই আড়িয়াল খাঁ নদী নিয়ে আমি নিজেই লিখেছি। অথচ দেখা যাচ্ছে, আরেকটি আড়িয়াল খাঁ নদীর অস্তিত্বই কেবল নেই, বালু সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যে তার অস্তিত্বও বিনষ্ট হতে চলছে।

প্রশাসন ব্যস্ত ত্রাণ তৎপরতায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যস্ত লোকজনকে ঘরে রাখতে। নদী আন্দোলনকারীরা ঘরবন্দি। এই ফাঁকে বালুসন্ত্রাসীরা 'নির্বিঘ্নে' তাদের অকাজ চালিয়ে গেছে। দেশের নদ-নদীতে বালু উত্তোলনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে আমি অনেক দিন ধরে কাজ করছি। গবেষণা করছি, লিখছি, সাক্ষাৎকার দিচ্ছি, কথা বলছি। কিন্তু এবারের মতো হতাশ কখনও লাগেনি।

বালু তোলার জন্য দেশে একটি আইন ও বিধিমালা আছে। জেলা প্রশাসকরা ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বিভিন্ন নদীতে ঘোষিত 'বালুমহাল' ইজারা দিয়ে থাকে। সেই ইজারা নিয়ে নানা কথা রয়েছে। একটা বালুমহাল ইজারা নিয়ে পুরো এলাকাকে লাখেরাজ সম্পত্তি মনে করার নজিরও কম নেই। এমনকি ইজারা ছাড়াই কেবল গায়ের জোরে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বালু তোলার চিত্র আমরা প্রায়শই দেখি। কিছু জেলা আছে, যেখানে কোনো বালুমহাল নেই। সেগুলোর একটি কুড়িগ্রাম। অথচ তুহিন ওয়াদুদ যে রাজারহাটের কথা বলেছেন, সেটা কুড়িগ্রামের মধ্যেই। আমার নিজের এলাকা রৌমারীতেও ব্রহ্মপুত্র ও সোনাভরি নদীতে বালু তুলছে একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবশালী মহল। অথচ সেখানে বালুমহাল থাকারই প্রশ্ন আসে না। দেখলাম, এপ্রিলের ২৬ তারিখ ডেইলি স্টারে এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। প্রতিবেদক কর্তিমারী ঘাটে নেমে দেখেছেন সারি সারি 'ড্রেজার'। অথচ বালুমহালমুক্ত এই জেলার কোথাও 'বৈধভাবে' বালু উত্তোলনের প্রশ্নই থাকে না। বালুমহাল আইনের যে পাতলা আব্রু, সেটাও আর গায়ে রাখতে চাইছে না বালুসন্ত্রাসীরা।

নদী থেকে বালু তুললে কী ক্ষতি হয়, তার প্রমাণ এখন আর তাত্ত্বিকভাবে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। সাধারণ মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকা দিয়ে বুঝতে পারছে। এপ্রিলের প্রতিবেদনগুলোতেই দেখছিলাম- ফসলি জমি ভাঙছে, বসতবাড়ি ভাঙছে। আমরা অনেক দিন বলেছি, বালু তুললে নদীর জীববৈচিত্র্য কীভাবে ধ্বংস হয়। যদি বালুমহাল আইনের নিয়ম মেনেও তোলা হয়, মাছের আবাস ও প্রজনন বিনষ্ট হবেই। মাছ মানে নিছক মলাঢেলা নয়। চট্টগ্রামের হালদা নদীতে কয়েক দিন পরপরই ডলফিনের মৃতদেহ ভেসে ওঠে। সর্বশেষ মঙ্গলবার সমকালের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে বীভৎস কায়দায় হত্যা করা ডলফিনের ছবি। তার সঙ্গে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত আড়াই বছরে অন্তত ২৪টি ডলফিনের মৃতদেহ মিলেছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি, বলাবাহুল্য। কার্প জাতীয় মাছের এই প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রে যেসব ট্রলার ও ড্রেজার দাপিয়ে বেড়ায়, এসব মৃত্যুর জন্য তারা ছাড়া আর কে দায়ী হতে পারে?

বালু তোলা নিয়ে খুনোখুনির খবর পুরোনো। বালু তোলার গর্তে যে চোরাবালি তৈরি হয়, সেখানেও কতজন প্রাণ হারাচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। ৫ এপ্রিল বাংলা নিউজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল কক্সবাজারের চকোরিয়া থেকে। বালু তোলার গর্তে পড়ে দুই মাদ্রাসাছাত্রী প্রাণ হারিয়েছে। আহারে জীবন! আমাদের নদীগুলোও এভাবে ক্রমেই বালুসন্ত্রাসীদের চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এদের হাত থেকে জীবন, জীবিকা, জীববৈচিত্র্য, মানুষ বাঁচানোর কি কেউ নেই?

বেআইনি বালু তোলার বিরুদ্ধে আইনের বিধান রয়েছে। কিন্তু বালুচোরেরা যেখানে করোনার ভয় পাচ্ছে না, সেখানে তারা এই ধর্মের কাহিনী শুনবে? যদি জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসেন, তাহলে হয়তো খানিকটা রেহাই পাওয়া যাবে। এর নজির দেখা গেছে কোনো কোনো এলাকায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশিরভাগ জনপদেই বালুসন্ত্রাসীবিরোধী তৎপরতা নিছক নিয়ম রক্ষা, রুটিন ওয়ার্ক। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপালিত হয় না। বা দায়সারাভাবে প্রতিপালিত হয়। মনে আছে, গত বছর জুন মাসে রাজশাহীর তালাইমারীতে পদ্মা নদীর বালু উত্তোলন নিয়ে হাইকোর্ট চরম উষ্ফ্মা প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে না পারলে জেলা প্রশাসকদের উচিত চাকরি ছেড়ে দেওয়া।

করোনাকালে ঘরবন্দি থেকে আমরা দেখছি, সবই বহাল তবিয়তে। যেমন বালুচোরারা, তেমনই বালু রক্ষকরা। পরিবেশ, প্রতিবেশ, নদী, পানি সুরক্ষার আইনগুলো ধর্মের কাহিনীর মতো কেবল কেতাবেই পড়ে থাকবে?

লেখক ও গবেষক
মহাসচিব, রিভারাইন পিপল