সমকাল : করোনাভাইরাসে চলমান লকডাউনের কারণে গ্রীষ্ফ্মকালীন বিভিন্ন ফল ও সবজি বিক্রি করতে পারছে না কৃষক। কিছু বিক্রি হলেও ভালো দাম না পেয়ে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমতাবস্থায় কৃষকরা কীভাবে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেন?
এ এম এম শওকত আলী : ইতোমধ্যে যে ক্ষতি হয়ে গেছে তার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি। পরিবহনের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা ক্ষতিয়ে দেখা দরকার। কারণ পণ্য পরিবহনের জন্য আন্তঃজেলা পরিবহন চলাচলে কোনো বাধা ছিল না। পরিবহন মালিকরা হয়তো গাড়ি বের করতে দেননি। জেলাভিত্তিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা দরকার। আমি মনে করি, কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে কৃষি মন্ত্রণালয় উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করবে।
সমকাল : কৃষক ইতোমধ্যে বোরো ধান ঘরে তুলতে শুরু করেছে। হাওরাঞ্চলে ধান কাটা শ্রমিক নিয়ে সংকট থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রায় সব ধান কাটা হয়েছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কী হবে?
শওকত আলী: ধান কাটার জন্য বিশেষ উদ্যোগে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে। যেমন কুমিল্লা অঞ্চলের অনেক শ্রমিক হাওরে গেছে। হাওরে ধান কাটার জন্য হারভেস্টার সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যরা বিশেষ করে ছাত্ররা কৃষকদের ধান কাটার কাজে সহযোগিতা করছে। এগুলো প্রশংসনীয় উদ্যোগ। মিডিয়া ও কর্তৃপক্ষের বিশেষ মনোযোগে হাওরের সংকট কাটানো গেছে। কিন্তু সমস্যা হলো এপ্রিলে হাওরাঞ্চল ছাড়া অন্যান্য জেলায় ধান কাটার চাপ কম থাকে। মে ও জুন মাসে বাকি জেলাগুলোতে চাপ থাকে। ফলে এখন অন্যান্য অঞ্চলে যাতে শ্রমিক সংকট না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। হাওরাঞ্চলের মতোই মনোযোগ দিতে হবে।
সমকাল : গত দুই বছর আমদানিসহ বিভিন্ন কারণে কৃষকরা ধানের ভালো দাম পাননি। এ বছর কী হতে পারে?
শওকত আলী : আমদানির কারণে কৃষকরা ভালো দাম পায়নি- সবসময় এ কথাটিই বলা হয়। কিন্তু ভালো দাম না পাওয়ার ক্ষেত্রে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। আমার জানা মতে, ২০১৯ সালে সরকার লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি ধান সংগ্রহ করেছিল। কৃষকের ভালো দাম না পাওয়ার মূল কারণ ছিল মিল মালিকরা। তারা হাইব্রিড ধান থেকে উৎপাদিত চালের দাম কম দিয়েছিল। আবার সরকারিভাবে যে পরিমাণ ধান সংগ্রহ করা হয়েছে, তার ৯২ শতাংশই সরবরাহ করেছে মিল মালিকরা। তারা কৃষকের কাছ থেকে কম দামে চাল কিনে সরকারের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে। ফলে লাভ তাদেরই হয়েছে। এ বিষয়টি ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। কৃষি মন্ত্রণালয় বিষয়গুলো দেখছে। হয়তো ধান ক্রয়ের ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালার পরিবর্তন আসবে। এ ছাড়া সব কৃষক কিন্তু সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারেনি। আমার জানামতে, ২০১৯ সালে প্রায় ৫০ ভাগ কৃষক ধান বিক্রি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
সমকাল : এর কারণ কী?
শওকত আলী : কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের সময় তার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি হলে তা ক্রয় করা হয়। আমাদের দেশে অটোম্যাটিক রাইস মিলের সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের কাছে আর্দ্রতার প্রশ্নটা মুখ্য না। কারণ তারা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ধান শুকিয়ে নেয়। এটা যদি হয় তাহলে প্রশ্ন জাগে- কৃষকদের কেন আর্দ্রতা নিশ্চিতের কথা বলা হয়, এটা তো অটোম্যাটিক রাইস মিলের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। এক্ষেত্রেও নীতিমালার দরকার আছে। আরেকটি সমস্যা হলো, দেরিতে ধান সংগ্রহ কর্মসূচি। এপ্রিলে যদি ধান কাটা শুরু হয় তাহলে অন্তত এক মাস আগেই ধান সংগ্রহের যাবতীয় কর্মসূচি সম্পন্ন হওয়া দরকার। এ বছরও সেটা হয়নি। এপ্রিলের শুরুতে ধান কাটা শুরু হলেও ধান সংগ্রহের সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে গত তিন থেকে চার দিন আগে। আরেকটি সমস্যা হলো জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে সঠিক সময়ে কৃষকদের তালিকা দেওয়া হয় না।
সমকাল : কৃষক অ্যাপের মাধ্যমে ২২ জেলার ২২ উপজেলা থেকে ধান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই অ্যাপের মাধ্যমে সব উপজেলা থেকে সরকারিভাবে ধান ক্রয় করা গেলে কেমন হবে?
শওকত আলী : সাধারণত সব জেলা থেকে ধান সংগ্রহ করা হয় না। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা থেকে বেশিরভাগ ধান সংগ্রহ হয়ে থাকে। এসব জেলায় ধান কাটার সময়ের সঙ্গে হয়তো ধান সংগ্রহের সময়টার মিল রয়েছে। তারপরও কেন এই ২২ উপজেলা নির্ধারণ করা হয়েছে, সে বিষয়টি পরিস্কার করা দরকার। সরকারি কর্মকর্তারা হয়তো বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।
সমকাল : প্রতিবছর সরকারিভাবে ধান ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে থাকে। অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে কী করা যেতে পারে?
শওকত আলী : দুটি কারণে দুর্নীতি হয়ে থাকে। এক. নিজের পকেট ভারী করা, দুই. স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপ। প্রভাবশালীরা চাপ দিয়ে প্রকৃত কৃষক নয়- এমন ব্যক্তিদের থেকে ধান সংগ্রহে বাধ্য করে থাকে। এ ছাড়া, রাজনৈতিক চাপ ও স্বজনপ্রীতিও এর জন্য দায়ী। এগুলো বন্ধ করতে হলে কৃষকদের প্রতিবছর তালিকা করা বন্ধ করতে হবে। তবে তালিকা হালনাগাদ করা যেতে পারে। ২০১১ সালে ১০ টাকায় ১ কোটি ১৩ লাখ কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করা হয়েছে। সেই তালিকা তো সরকারের হাতে আছে। এ ছাড়া কৃষি ঋণ যারা নেন তাদেরও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এগুলো সমন্বিতভাবে হয় না। এ জন্য বিভ্রান্তি বেশি হয়।
সমকাল : হাটবাজারগুলো চালু রাখার পক্ষে-বিপক্ষে কথা রয়েছে। এই দুর্যোগকালীন হাটবাজার চালু রাখার বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
শওকত আলী : হাট-বাজার বন্ধ থাকলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটা যেমন সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য হলো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা না খেয়ে থাকবে। এ ছাড়া, যারা ভোক্তা তাদেরও না খেয়ে থাকতে হবে। এ জন্যই সরকার পণ্য পরিবহনে বাধা দেয়নি। তবে হাট-বাজারগুলো স্বাস্থ্যসম্মতভাবে চালু রাখার ব্যাপারে জেলায় জেলায় সিভিল সার্জনরা পদক্ষেপ নিতে পারেন।
সমকাল : গরুর দুধ, মুরগি ও ডিমের বিক্রি কমায় এগুলোর দামও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে খামারি বা উদ্যোক্তারা লোকসানের মুখে পড়েছেন। তাদের করণীয় কী?
শওকত আলী : প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। উদ্যোক্তাদের পুনর্বাসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সমকাল : কৃষকদের ৫ শতাংশ সুদে প্রণোদনার ঋণ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ ঋণ ব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া দরকার?
শওকত আলী : প্রণোদনার এ ঋণ অবশ্যই উৎপাদনের কাজেই ব্যবহূত হতে হবে। ঋণ নিয়ে যাতে কোনো অনিয়ম না হয় এবং প্রকৃত কৃষকরাই যাতে ঋণের সুবিধা পান, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। কৃষির সব সেক্টর যাতে ঋণের আওতায় আসে, সে বিষয়েও নজর দিতে হবে।
সমকাল : করোনা-পরবর্তী বিশ্বব্যাপী কৃষির প্রতি মানুষের মনোযোগ বাড়বে বলে ধারণা করছেন অনেকেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে? বাংলাদেশ তো শিল্পায়ন ও নগরায়ণের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে?
শওকত আলী : পৃথিবীর অনেক দেশই নগরায়ণে প্রাধান্য দিয়েছে। বিষয়টি হলো, পরিকল্পিত নগরায়ণ হলে সমস্যা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে পরিকল্পিত নগরায়ণ না হওয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। নগরায়ণের কারণে কৃষি জমির ক্ষতিসাধন হচ্ছে। ২০০০ সালের ভূমি ব্যবহার নীতিতে বলা হয়েছিল, দুই বা তিন ফসলি জমি যেন অকৃষি খাতে ব্যবহার না হয়। জমি অধিগ্রহণে যাতে এ বিষয়টি গুরুত্ব পায়, তা দেখা উচিত। আমাদের নগরায়ণ ও শিল্পায়ন থেকে সরে আসার সুযোগ নেই। শিল্পায়ন ও নগরায়ণ যাতে কৃষি ও সার্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য হুমকির কারণ না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
সমকাল : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
শওকত আলী : সমকালের জন্য শুভ কামনা।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : সাইফুল ইসলাম

বিষয় : ধান ক্রয়ে অনিয়ম

মন্তব্য করুন