যে যায় সে যায়, ফিরে আসে না
আবেদ খান
প্রকাশ: ২১ মে ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর -০০০১ | ০০:০০
শুধু করোনা মহামারি নয়, এদেশের মননশীলতার জগতে এক ভয়ংকর কৃষ্ণ-গহ্বরে নিপতিত হচ্ছে। একের পর এক আমাদের গুণীজনেরা চলে যাচ্ছেন। এক সময় আমাদের সামনে ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল, তিনি চলে গেলেন। জাহানারা ইমাম ছিলেন, তিনি চলে গেলেন। কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, গাজীউল হক, ফয়েজ আহমদ, কামরুল হাসান, ওয়াহিদুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, মমতাজ উদদীন আহমদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর- এরা সবাই চলে গেলেন। চলে গেলেন ড. আনিসুজ্জামানও।
অত্যন্ত অল্প বয়সে যারা এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তাদের সবাই একে একে চলে যাচ্ছেন। আমাদের সমস্ত আলো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। যে আলো আর কখনও জ্বলার সম্ভাবনা দেখি না।
জানি না, কীভাবে লিখতে পারলে আমি আমার মনকে প্রবোধ দিতে পারব। ড. আনিসুজ্জামানের চলে যাওয়া সমাজ এবং বাঙালি জাতির জন্য বিশাল ইন্দ্রপতন। তিনি আমার কাছে দীর্ঘকাল যাবৎ ছিলেন এক অভিভাবকের মতো। এই দীর্ঘকাল যে কত দীর্ঘ কাল তা মনে করতে হলে চলে যেতে হবে আমার শৈশবের সেই সময়ে। যখন ঢাকার নতুন অংশ বলে কিছু ছিল না। গুলিস্তানের অস্তিত্ব ছিল না। ফুলবাড়িয়া স্টেশন, নবাবপুর রোড, ওয়ারী, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ ঘিরে আরেক ঢাকা। আসলে সেই সময়ে আমরা যুবক আনিসুজ্জামানকে দেখেছি। তার পিতা ডাক্তার মোয়াজ্জেম আমার পিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সেই সুবাদে পারিবারিকভাবে আমাদের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্কও ছিল। আমার শৈশবকালের অনেক দুষ্টুমির চিহ্নও আছে সেই ডাক্তার মোয়াজ্জেমের চেম্বারে। অবশ্য এ প্রসঙ্গ এখানে অপ্রয়োজনীয়।
ড. আনিসুজ্জামানকে আমরা বিভিন্ন প্রয়োজনে সব সময় কাছে পেয়েছি। আমাদের আন্দোলনে, আমাদের লড়াইয়ে, আমাদের সংগ্রামে, বুদ্ধিবৃত্তির জগতে প্রতিমুহূর্তে তার দ্বারস্থ হয়েছি। তার আগেও অনেকেই ছিলেন। যাদের আমরা হরিয়ে ফেলেছি। যারা একবার চলে গেছেন তারা কিন্তু আর ফেরত আসেননি। সেই জায়গাটা সেই রকম অপূর্ণই রয়ে গেছে। সেই শূন্যতা অনেককাল ধরে পূরণ করেছেন ড. আনিসুজ্জামান। আমাদের নির্ভরতার বটবৃক্ষ। এই ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান।
রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের ভাষায় কথা বলা, স্লোগানে মিছিলে সাথী হিসেবে তিনি ছিলেন সবসময় আমাদেরই পাশে। বিপর্যয়ের মুহূর্তে আমরা পেয়েছি তার পরামর্শ। তিনি সচল রেখেছেন আমাদের কর্ম এবং চিন্তার জগৎকে।
সেই ড. আনিসুজ্জামান এবারে চলে গেলেন। তার কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ভাবি তারই নেতৃত্বে আমরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছি- বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও- এই সংগঠনের ব্যানারে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য যে ফতোয়াবাজ ও ধর্মীয় জঙ্গিরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়েছিল, তাদেরই বিরুদ্ধে এই সংগঠনের মাধ্যমে আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। সরাসরি আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও সংগঠনটি অল্পদিনের মধ্যেই দেশের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে উপমহাদেশ এবং ইউরোপ, আমেরিকা, আস্ট্রেলিয়ার প্রতিটি সাংস্কৃতিক এবং মুক্তবুদ্ধির মানুষের কাছে অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি প্রতীক হয়ে গিয়েছিল।
এই আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে ছিলেন সুলতানা কামাল, ডা. সারওয়ার আলী, জিয়া উদ্দিন তারেক আলী এ রকম আরও করেকজন। পরবর্তী পর্যায়ে অনেকেই আমাদের এই ব্যানারে সক্রিয় হয়েছিলেন। আমরা ছুটে বেড়িয়েছি কক্সবাজারের রামু থেকে পাবনা, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কুমিলল্গা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দিনাজপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। যেখানেই সংখ্যালঘু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, সেখানেই 'বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও'-এর ব্যানারে ড. আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে আমার ছুটে গিয়েছি। আমাদের সেই তৎপরতায় সাম্প্রদায়িক শক্তি অনেকখানি নিষ্ফ্ক্রিয় হয়েছে, শক্তি সঞ্চয় করেছে মুক্তবুদ্ধি এবং মুক্ত চেতনার মানসিকতা। কিন্তু এখানেই তিনি থেমে থাকেননি, মুক্তবুদ্ধির বিজয়কে সংহত করতে একাধিক সংগঠনের মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে একটি বার্তায় তিনি দিয়ে গেছেন যে, মানুষের কাজ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেও বিকশিত করা। এই জায়গায় আমাদের সবাইকে একাত্ম থাকতে হবে। যখনই দেশে কোনো রকম সংকট সৃষ্টি হয়েছে, এমনকি কখনও কখনও সরকারের কোনো মহল যদি বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেই ক্ষেত্রেও ড. আনিসুজ্জামান প্রতিবাদ মুখর হয়েছেন। এমনকি তিনি হুমায়ূন আহমেদের সেই প্রতিবাদী অনশনে অংশগ্রহণের জন্য সিলেট পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিলেন। এই ছিলেন ড. আনিসুজ্জামান।
অতিসম্প্রতি আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের অভাব আর কিছুতেই পূরণ করা যাবে না। আমাদের মেধা ও মননশীলতার জগৎটা ক্রমশ শূন্য এবং দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। আজ অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে বলতে হয়, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের একজন শক্তিমান সেনানী, প্রথিতযশা সাংবাদিক কামাল লোহানী এখন জীবনের শেষ প্রান্তে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। আজীবন লড়াকু এই মানুষটি বারবার কারাজীবন বরণ করেছেন, পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করেছেন। আমি বিশ্বাস করি তিনি আমাদের কাছে আবার ফেরত আসবেন আপসহীন লড়ায়েরই পতাকা হাতে নিয়ে।
আমরা এখন স্মরণ করছি সবাইকে যাদের হারিয়েছি এবং হারাতে চাই না। তাদের দেখানো পথেই আমরা এখন পথ চলছি। আমরা চেষ্টা করে চলেছি বিবেকের পথটা নতুন করে রচনা করতে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আজকে নেই। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর নেই। জামিলুর রেজা চৌধুরী নেই। এদের প্রয়াণ হয়েছে সাম্প্রতিককালেই। তাদের এই জায়গাগুলো পূরণ করার মতো আর তো কোনো মানুষ নেই। সৈয়দ শামসুল হককে আমরা হারিয়েছি। আমরা ইতোমধ্যেই মুস্তফা নুরউল ইসলামকে হারিয়েছি। তারও আগে আমরা কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমানকে হারিয়েছি। সবাই চলে গেছেন। কেউ একজন যখন চলে যান তখন সেই জায়গায়টি আমরা আর পূরণ করতে পারি না। কবি আহসান হাবীব তার একটি কবিতায় বলেছিলেন, 'যে যায় সে যায়, ফিরে আসে না।' আসলে তাদের সেই চেতনার বৈভব নিয়ে তারা ফেরত আসেন না, কিন্তু রেখে যান সেই অমর বাণী, আমাদের চোখটাকে রাখতে হবে সামনের দিকে, আমাদের বিশ্বাসকে রাখতে হবে আমাদের পথচলায়। এখন এই মেধার জগতে যেভাবে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, সেই শূন্যতা পূরণ করার জন্য আমাদেরকে ন্যায়নীতি এবং চিন্তার জগৎকে সম্প্রসারিত করতে হবে। শূন্যকে পূর্ণ করার এই সাধনা থাকুক অটুট।
সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ