- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- সুন্দরবনই বারবার বাংলাদেশের সুরক্ষাকবচ
ঘূর্ণিঝড় আম্পান
সুন্দরবনই বারবার বাংলাদেশের সুরক্ষাকবচ

সুন্দরবন আমাদের জন্য ও বিশ্বের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নতুন করে বুঝিয়ে বলার বিষয় নয়। জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে একটি অনন্য সাধারণ প্রতিবেশ ব্যবস্থা বলেই এই বন ও অভ্যন্তরীণ জলাভূমি জাতিসংঘের দুটি সংস্থা থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে একটি বিশ্ব ঐতিহ্য স্থল ও একটি রামসার সাইট হয়েছে। আমাদের জানমালের জন্যও এই বন কীভাবে বারবার সুরক্ষাকবচ হয়ে আসে, বুধবারের ঘূর্ণিঝড় আম্পানের মধ্য দিয়ে তা আরেকবার প্রমাণ হলো। আজ যদি সুন্দরবন না থাকত, তাহলে অবস্থা কী হতো! ঝড়টা বাংলাদেশের দিকে ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। কারণ, সুন্দরবন সুরক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। এর আগে সিডরেও এভাবে দাঁড়িয়েছিল। আইলার সময় দাঁড়িয়েছিল।
মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন মানুষের সৃষ্টি নয়। প্রকৃতিই আমাদের এ বন দিয়েছে। এও মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন ও এর জলাশয় এ দুটির কোনোটিই আর শুধু বাংলাদেশের সম্পদ নয়। বৈশ্বিক স্বীকৃতি আসার সঙ্গে সঙ্গেই এগুলো বিশ্ববাসীর হয়ে গেছে। এগুলোকে রক্ষা করা আমাদের আইনগত দায়িত্ব, নৈতিক দায়িত্ব, সামাজিক দায়িত্ব, অর্থনৈতিক দায়িত্ব ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ব। সুন্দরবনকে রক্ষা করা অর্থনৈতিক দায়িত্ব বলেছি। কারণ, এ বনকে কেন্দ্র করে প্রায় ২০ লাখ মানুষ সরাসরি তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তাদের কেউ মধু সংগ্রহ করে, লতাগুল্ম-পাতা সংগ্রহ করে, কেউ আবার জলাশয় থেকে মাছ সংগ্রহ করে। সুন্দরবন রক্ষাকে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলেছি এ কারণে যে, এই ২০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহে সেখানে কিছু রেওয়াজ হয়েছে। কতগুলো সংস্কৃতি মেনে তারা বনে প্রবেশ করে।
সুন্দরবনের বৃক্ষরাজি কার্বন শোষণ করে থাকে। যদি বনটি না থাকে এবং এই পরিমাণ কার্বন যদি বাতাসে মিশে যায়, তাহলে বাংলাদেশের আবহাওয়া মারাত্মক উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। ফলে স্বাস্থ্যগত অনেক ঝুঁকি থেকে আমরা বেঁচে যাচ্ছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই বিষয়গুলো আমরা বুঝতে চাইছি না। আমরা সুন্দরবনের ভেতরে কটেজ বানানোর চেষ্টা করছি। বনের একাংশে গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করারও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আমরা ভুলে যাই যে, সুন্দরবন একটি 'ইকোসিস্টেম'। তার মানে, শুধু বন নয়, এর আশপাশের অঞ্চলও সুরক্ষিত রাখতে হবে। আমরা যেন সুন্দরবনের আশপাশের অংশকে শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। এর মূল কারণ হলো, বনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে ও নৌপরিবহন সুবিধা। এই সুবিধা নিয়ে আমরা সেখানে সব ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে চাচ্ছি। যার মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত হলো রামপাল তাপভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এ বিষয়ে স্বয়ং ইউনেস্কো যখন বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে সরকারকে নিবৃত রাখার চেষ্টা করেছে, সরকার তখন সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে প্রকল্প নির্মাণের কথা জানিয়েছে।
সুন্দরবনের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রসঙ্গে তাহলে প্রশ্ন ওঠে- তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পটি রামপালে কেন? অন্যত্রও তো বিদ্যৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা যায়। আমরা দেখছি, রামপালে নির্মাণকাজ শুরুর পর আরও নানা করপোরেট গ্রুপ সেখানে কলকারখানা নির্মাণ শুরু করেছে। সেখানে এখন ইটভাটা হচ্ছে, নানা রকম এলএনজি স্টেশন হচ্ছে, প্রাইভেট পাওয়ার প্লান্ট হচ্ছে।
বাংলাদেশ যে দেশের সঙ্গে যৌথভাবে রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, সেই ভারত কিন্তু তার অংশের সুন্দরবনের সীমানার ২০ কিলোমিটারের মধ্যে এ ধরনের কাজ করতে দেবে না। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে মিলে সুন্দরবনের বাংলাদেশ সীমান্তের ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে এ কাজ করছে জাতিসংঘের একটি সংস্থার আপত্তি উপেক্ষা করে। ইউনেস্কোকে উপেক্ষা করে এত বড় একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ বোধগম্য নয়।
মনে রাখা দরকার, সুন্দরবন কেবল একটি প্রজন্মের জন্য নয়। পূর্বসূরিরা আমাদের জন্য এই বন রেখে গেছেন। আমাদের উচিৎ হবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বনটিকে যথাযথভাবে রেখে যাওয়া। আমাদের মহান সংবিধানে বলা আছে- আমরা বন রক্ষা করব, বন্যপ্রাণী রক্ষা করব, পরিবেশ রক্ষা করব বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আমরা এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গল্প শুনবে যে, একদা একটা সুন্দরবন ছিল, সেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছিল। আমরা কি সেটাই চাই? আমরা কি তাদের জন্য শুধু বিদ্যুৎ প্রকল্প রেখে যাব? তাহলে ঘূর্ণিঝড় থেকে তাদের বাঁচাবে কে?
আমরা জানি, সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন নিষিদ্ধ ছিল। বছর দুয়েক আগে জাতীয় পরিবেশ কমিটির এক সভায় এগুলোকে অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাতারাতি লাল তালিকাভুক্ত এসব প্রতিষ্ঠানকে সবুজ তালিকায় নিয়ে এসে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়। হাইকোর্টের নির্দেশনাও ছিল সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে লাল তালিকাভুক্ত কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান হবে না। কিন্তু আমরা সরেজমিন দেখতে পাই, সেখানে প্রচুর শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে।
বুধবার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কভিড-১৯ সংটের পর জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বেশি উদ্যোগী হতে হবে। প্রশ্ন হলো- আমরা নিজেরাই যদি কয়লা পুড়িয়ে কার্বন ছড়িয়ে দিই, তাহলে অন্যদের কীভাবে নিষেধ করব? আমরা সেই উন্নয়নের পথে কেন হাঁটব, যে উন্নয়নের পথে হেঁটে আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, চীন আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিপর্যয়কে উপহার দিয়েছে। তারা যখন উন্নয়ন করেছে তখন বিকল্প ছিল না, কিন্তু আমরা যখন উন্নয়ন করছি, তখন বিকল্প আছে। একই সঙ্গে সনাতনী উন্নয়নের যে নেতিবাচক দিক, সেটাও আমাদের সামনে সুস্পষ্ট। আমরা জানি, আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতেই হবে। এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখবে বন। কারণ, বন কার্বন টেনে নেবে। আর তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প কার্বন ছাড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধ, তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ সবকিছুতেই সুন্দরবন এভাবে আমাদের পাশে দাঁড়ায়। এটি নীতিনির্ধারকদের অজানা, এমন নয়। জানে বলেই দেশের অন্যান্য উপকূলে গ্রিন বেল্ট তৈরি করছে। একদিকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে গাছ লাগিয়ে গ্রিন বেল্ট তৈরি করা হচ্ছে, আরেক দিকে প্রকৃতির দেওয়া সুরক্ষাকবচ সুন্দরবনকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে এবং জনমত উপেক্ষা করে। মনে রাখতে হবে, আমরা চাইলে একশ'টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে পারব, কিন্তু আরেকটি সুন্দরবন করতে পারব না।
সুন্দরবনে পোস্টিং পাওয়া নিয়ে আমরা বিভিন্ন গল্প শুনি। বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করার পর কেবল সেখানে পোস্টিং মেলে। যারা রক্ষক তাদের বিরুদ্ধে যখন ভক্ষণ করার অভিযোগ জোরালোভাবে উঠে আসে, তখন আমাদের বুঝতে হবে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে সুন্দরবনকে ফেলা যাবে না। বরং জনগণকে সম্পৃক্ত করে সুন্দরবনকে কতটা নির্জনে রাখা যায়, সেটাই ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য হওয়া দরকার। সুন্দরবনকে রক্ষা করার জন্য আলাদা কোনো প্রচেষ্টা বা ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না। শুধু বনটিকে বিরক্ত না করলেই তা সবুজ-সতেজ থাকে। আমরা সিডরের সময় দেখেছি বনটির একাংশ প্রায় শেষ হয়েছিল। বিরক্ত না করার কারণে তা আগের অবস্থায় চলে এসেছে। মাগুরছড়ায় আগুন লাগার সাত-আট বছর পর আমরা ওই স্থানে পরিদর্শনে গিয়ে দেখেছি সেখানে এমনভাবে সবুজ ফিরে এসেছে, বোঝার উপায় নেই যে, কখনও আগুন লেগেছিল। আমাদের প্রতিবেশ ব্যবস্থা এরকমই সমৃদ্ধ; বাড়তি কোনো উদ্যোগ নিতে হয় না। আমরা শুধু একটু 'নিষ্ফ্ক্রিয়' থাকলেই সুন্দরবন ভালো থাকবে এবং বাংলাদেশকে ভালো রাখবে।
প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি, বেলা
মন্তব্য করুন