করোনা পরিস্থিতির কারণে আম্পানের আগমন যদিও এবার একটি অস্বাভাবিক সময়ে, এই মৌসুমে ঘূর্ণিঝড় বঙ্গীয় ব-দ্বীপের জন্য স্বাভাবিক। আবহমানকাল থেকে বছরের মে-জুন ও সেপ্টেম্বর-নভেম্বর সময়ে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করেই বন্যার মতো ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গেও বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় জনগোষ্ঠী। আমরা দেখলাম, আম্পানের মতো 'সুপার সাইক্লোন' সত্ত্বেও প্রাণহানি অপেক্ষাকৃত কম। একই ঝড়ে প্রতিবেশী ভারতে প্রাণ ও সম্পদহানি তুলনামূলক বেশি। সন্দেহ নেই, প্রত্যেকটি প্রাণই মূল্যবান। আমরা চাই, ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি যেন শূন্যে নেমে আসে। কিন্তু তা নির্ভর করে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার অবকাঠামোগত প্রস্তুতির ওপর। আমরা দেখছি, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রমেই সক্ষম হয়ে উঠছে। বিশেষত নব্বইয়ের দশকের আগে যেখানে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাত, এখন সেখানে তিন সংখ্যার প্রাণহানিও বিরল। বস্তুত গত পাঁচ বছরের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলোর কোনোটিতে প্রাণহানির সংখ্যা দুই অঙ্ক অতিক্রম করেনি। এখনও যদিও পূর্ণ চিত্র সামনে আসেনি, আমরা মনে করি গত বছরের ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বা ফণীর মতো আম্পানেও প্রাণহানি সীমিত রাখা গেছে।

বস্তুত ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা এখন বৈশ্বিক উদাহরণ। আমাদের দেশে নব্বই দশকে প্রণীত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্থায়ী আদেশ একটি কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে প্রমাণিত। যে কারণে নব্বইয়ের দশকের পর ক্রমেই কমতে থাকে প্রাণহানি। ঘূর্ণিঝড় থেকে সুরক্ষায় স্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নকশা করার উদ্যোগও যথেষ্ট উদ্ভাবনীমূলক। এমনকি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবন মোকাবিলায় যে মাটির ঢিবি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা এখনও দুর্যোগ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখছে। তারই নামে 'মুজিব কেল্লা' নামে পরিচিত এ ব্যবস্থা বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় থেকে গবাদি পশু রক্ষার জন্য হয়ে উঠছে অন্যতম প্রধান ভরসা। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা যেভাবে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যায়, তার উদাহরণও বিশ্বে কম রয়েছে। আমাদের মনে আছে, ইউরোপ ও আমেরিকায় ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নেওয়ার দাবি উঠেছে। এও স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস ব্যবস্থাও এখন আন্তর্জাতিক মানের। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও পক্ষের সঙ্গে যৌথভাবে আমরা এখন তিন-চার দিন আগেই ঘূর্ণিঝড়ের ধরন ও সম্ভাব্য গতিপথ বলে দিতে পারি। যদিও সতর্কীকরণ বার্তা বা সিগন্যাল নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। আমরা বিশ্বাস করি, নীতিনির্ধারকরা এ ব্যাপারে দ্রুততম সময়ের মধ্যে উদ্যোগী হবেন। ঘূর্ণিঝড়ের গতির সঙ্গে সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা নিয়েও আরও সুস্পষ্ট বার্তা দেওয়া উচিত। সাধারণ জনগণ যদি নিজেদের মতো করে বার্তা গ্রহণ করতে পারে, তাহলে সুরক্ষা ব্যবস্থা আরও মজবুত হবে।

একই সঙ্গে মেনে নিতে হবে, ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে আমাদের আরও উন্নতি করতে হবে। আমরা দেখেছি, আম্পানে উপকূলীয় জেলাগুলোতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেড়িবাঁধ। এগুলোর কোনো কোনোটি আইলার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখনই এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা বলেছিলাম, বাঁধের উচ্চতা বাড়াতে হবে। উপকূলীয় বাঁধ যদি মজুবত না হয়, তাহলে জলোচ্ছ্বাসে লোনা পানি ফসলের ক্ষেতে প্রবেশ করে খাদ্য উৎপাদন ও জীবিকা বিপন্ন করে তোলে। আম্পানে সেই আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়েছে মূলত বাঁধের দুর্বলতার কারণে। এ ছাড়া ত্রাণ বিতরণেও সাম্প্রতিক সময়ে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আম্পান-পরবর্তী ত্রাণ তৎপরতায় এর পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। উপকূলীয় বাঁধগুলো সংস্কার, পুনর্নির্মাণ ও উচ্চতা বৃদ্ধির কাজও শুরু করতে হবে অবিলম্বে। দুর্যোগ পূর্ববর্তী প্রস্তুতিতে আমরা সক্ষম, পরবর্তী ব্যবস্থাপনাতেও সক্ষমতা দেখতে চাই।