করোনা মহামারিতে শুধু অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেমে গেছে, তা নয়। থেমে গেছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও। মধ্য মার্চ থেকে বাংলাদেশে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা হয় এমন মিলনায়তনগুলো বন্ধ। উন্মুক্ত স্থানে কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে না। এমনকি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরে যে ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে, সেগুলোও এখন বন্ধ। ফলে এর সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সব টেকনিশিয়ান বেকার। চলচিত্রশিল্প বন্ধ, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যে নাটক, নৃত্য, গান বা অন্যান্য অনুষ্ঠান রেকর্ডিং হয়, সেটিও বন্ধ। চারুশিল্পীরা কাজ করতে পারছেন না; যাত্রাশিল্প, পাপেট শিল্পীদের কার্যক্রম বন্ধ। ফলে বেকার হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার স্বল্প আয়ের শিল্পী, বিশেষ করে পেছনে কাজ করা কর্মীবৃন্দ। তাদের পেটে ভাত নেই, কপালে চিন্তার ভাঁজ। এখন প্রশ্ন হলো, এসব শিল্পশ্রমিকের জীবন চলবে কীভাবে?
কী হবে থিয়েটারকর্মী, নৃত্যশিল্পী, চারুশিল্পী, বাউলশিল্পী, গম্ভীরা, ঢোলবাদক, যন্ত্রশিল্পী, মেকআপ আর্টিস্ট, সেট নির্মাণকারী, মঞ্চের পোশাক নির্মাতা, লাইট সহকারী, ফ্রিল্যান্সিং শিল্পী বা যারা গানের টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে তাদের? কিছু কিছু শিল্পীর খবর জেনেছি, তাদের ঘরে চুলা জ্বলে না। যন্ত্রশিল্পীদের কেউ কেউ ফোন করে বলেছেন, 'কোনো কাজ নেই, হাতে কোনো টাকা নেই; ছেলেমেয়ে, পরিবার-পরিজন নিয়ে কী করে বাঁচি।' ইতোমধ্যে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ঈদ উপলক্ষে সারাদেশের পাঁচ হাজার শিল্পীকর্মীকে পাঁচ হাজার টাকা করে প্রদান করার ঘোষণা দিয়েছে। যার কোনো প্রচার-প্রচারণা ছিল না, ছিল না কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিল্পীরা জানে না, কীভাবে আবেদন করতে হবে, কার কাছে যেতে হবে। তার পরেও ৪৯টি জেলা থেকে শিল্পকলা একাডেমির কাছে ১১ হাজার ৬৪৫ জনের নাম জমা পড়েছে। গড় হিসাবে বাকি ১৫টি জেলার তথ্য যদি যোগ করি, তাহলে প্রায় ১৫ হাজার ২১০ শিল্পী শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে সাহায্য চেয়েছেন। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে আরও কিছু শিল্পীর নাম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। যে সংখ্যা আমাদের জানা নেই। শিল্পীদের বুক ফাটে, তবু মুখ ফোটে না। তারপরও এতজন শিল্পী সাহায্য পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। আমার ধারণা, কমপক্ষে ৫০ হাজার শিল্পীকর্মী অসহায় অবস্থায় আছেন, যাদের কোনো উপার্জন নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমার কাছে যতটুকু খবর আছে, তাতে সরকার যে পাঁচ হাজার শিল্পীকে ঈদ উপলক্ষে সহায়তা করতে চেয়েছে, তার মধ্যে ঢাকা শহরের মাত্র ৬০০ শিল্পী সেই অনুদান পেয়েছেন। দেশের অন্যান্য এলাকার শিল্পীরা সেই অনুদানের অর্থ এখনও পাননি। জানি না, কবে সেটা তাদের হাতে পৌঁছাবে বা আদৌ পৌঁছাবে কিনা?
এই অচলাবস্থার মধ্যে অদৃষ্টবাদী ভাবনা প্রশ্রয় পাচ্ছে। কেউ কেউ সেটাকে আরও উস্কে দিচ্ছে। মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে এবং তা থেকে তাদের মধ্যে অবসাদগ্রস্ততা নেমে এসেছে। সে ক্রমান্বয়ে বিজ্ঞানমনস্কতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য মানুষের ভেতরে যে দৃঢ়তা দরকার, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার ঘটানো দরকার, মনে প্রশান্তি থাকা দরকার, মনকে শক্ত রাখা দরকার তা থেকে তারা ছিটকে পড়ছে। তার জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা দরকার, সংস্কৃতির শক্তিকে জাগ্রত করা দরকার।
ইতিহাস বলে, সংস্কৃতি বাস্তব প্রয়োজনে জন্মে এবং মানুষের জীবনসংগ্রামে শক্তি জোগায়, জীবনযাত্রার বাস্তব উদ্দেশ্য স্থির করে। জীবনযাত্রার ঘাত-প্রতিঘাতে সংস্কৃতির রূপ ও রং পরিবর্তিত হয়। সংস্কৃতি হচ্ছে সামাজিক সক্রিয়তার একটি ক্ষেত্র। সংস্কৃতি মানে নিরন্তর চর্চা, বহমানতা, উদ্ভাবন। সংস্কৃতিকর্মীরা এই মহামারিতে মুষড়ে না পড়ে নব নব উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে মানুষকে পথ দেখাবেন, সেটাই প্রত্যাশা। যার নিদর্শন ইতোপূর্বে বহুবার তারা দেখিয়েছেন।
১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় যখন মন্বন্তর দেখা দেয়, তখন চারদিক থেকে ভেসে আসতে থাকে মৃত্যুপথযাত্রী হাজার হাজার কঙ্কালসার মানুষের মিছিল। রব ওঠে 'ফ্যান দাও ফ্যান দাও' বলে। মানুষের সারিবদ্ধ লাশ পড়ে থাকে রাস্তার চারপাশে। সে সময়ও বিজন ভট্টাচার্য সৃষ্টি করেন এক অসাধারণ নাটক 'নবান্ন'। এ সময় সুকান্ত বের করেন 'আকাল' পত্রিকা, লেখেন তার 'বোধন' কবিতা। আর জয়নুল আবেদিন আঁকলেন 'দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা', যা সমগ্র বিশ্ববাসীকে কাঁপিয়ে দেয়। আমার বিশ্বাস, এবারের এই মহামারিতেও সংস্কৃতিকর্মীরাই পথ দেখাবেন। মানুষের অন্তর্গত শক্তিকে জাগ্রত করে নতুন দিনের আলোয় পথ দেখাবে। যে আলোর ঝলকানিতে কেটে যাবে অন্ধকার। আবার মানুষ গলা ছেড়ে গাইবে গান- 'সবকিছু গেলে আবার সব মেলে, তখন তো দেখি আবার হাসিমুখ।/ দুঃখের পরে ফিরে আসে সুখ, তখন তো দেখি আবার হাসিমুখ।'
সহসাধারণ সম্পাদক, উদীচী