এবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল 'প্রাণবৈচিত্র্য'। দিবসটির আগের সপ্তাহে ভারতের কেরালায় একটি গর্ভবতী বন্যহাতির নৃশংস হত্যার ঘটনা আমাদের বিবেককে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। এই প্রাণী হত্যার ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা বিশ্ব উষ্ণতা, পরিবেশ সুরক্ষা, বনায়ন ইত্যাদি বিষয়ে দারুণ সচেতন হলেও 'জীববৈচিত্র্য' বিষয়ে মোটেই সংবেদনশীল নই। প্রকৃতপক্ষে 'প্রাণবৈচিত্র্য-সংবেদনহীনতা' বিশ্ব পরিবেশ আন্দোলনের সবচেয়ে উপেক্ষিত ও দুর্বলতম দিক। কারণ, প্রথমোক্ত ধারার গবেষণায় কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও যোগোযোগ বিজ্ঞানের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকে। ফলে বিষয়গুলো জানা এবং জানানোর সচল তথ্যপ্রবাহে যুক্ত। কিন্তু জীববিজ্ঞান-গবেষণা এখনও ল্যাবরেটরিনির্ভর এবং গবেষণার ফলাফলও বিজ্ঞান জার্নালনির্ভর। বহির্জাগতিক যোগাযোগে জীববজ্ঞানীদের প্রশিক্ষণও কম। ফলে আমজনতার মধ্যে মানবপ্রজাতি ও প্রাণিকুলের পরস্পর সম্পর্ক বিষয়ে জানাশোনা নিতান্তই কম। তার মধ্যেও দুর্বলতম দিক মানুষের মধ্যে প্রাণীর মাধ্যমে রোগ ছড়াতে পারে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর না থাকা। অথচ মানুষ অঙ্গাঙ্গিভাবে প্রাণিজগৎ সম্পর্কিত।
কভিড নিয়ন্ত্রণে কেরালা এতটাই সফল যে, উপমহাদেশজুড়ে 'কেরালা মডেল' বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছে। বলা হচ্ছে ৯৬ শতাংশ সাক্ষরতা-হার এবং উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থাই কেরালার সাফল্যের চাবিকাঠি। কিন্তু হাতি হত্যার ঘটনা বলে দিচ্ছে- শিক্ষায় শীর্ষে গেলেই 'প্রাণবৈচিত্র্য-সচেতনতা' বাড়বে এমন সম্ভাবনা কম। কেরালায় প্রতিবছরই ব্যাপক সংখ্যক কুকুর নিধনের ঘটনা ঘটে। এমনকি নগরের সৌন্দর্য রক্ষা প্রকল্পের অংশ হিসেবে যুবকদের জন্য কুকুর নিধন প্রশিক্ষণ এবং চাকরির ব্যবস্থাও আছে। সাপ-বানর নিধনও রাজ্যটিতে স্বাভাবিক ঘটনা।
প্রাণী হত্যা সমস্যাটি বাংলাদেশেও প্রকট। মে মাসের ২৭ তারিখে সিলেটের জৈন্তাপুরে একদল গ্রামবাসী গর্তের মুখে আগুন দিয়ে আটকে ছয়টি শিয়াল, দুটি বাগডাশ ও একটি বেজি হত্যা করে। ৫ মে মাদারীপুরের চরমুগরিয়ায় খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে ১৫টি বানর হত্যা করা হয়। এপ্রিল-মে মাসে কক্সবাজার ও টেকনাফে বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী এলাকায় অনেকগুলো মৃত ডলফিন ভেসে এসেছিল। ডলফিনগুলোকে ক্রীড়াচ্ছলে নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়েছিল। পাকিস্তানেও বন্যপ্রাণী হত্যা অনিয়ন্ত্রিত। তার ওপর গত কয়েকটি বছরজুড়ে নির্বিচার কুকুর নিধন চলছে। এ বছরের এপ্রিলে আবারও করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের নামে সিন্ধুর নগর কর্তৃপক্ষ লাগাতার কুকুর নিধনে নামে।
সভ্য সমাজও অর্থের লোভমুক্ত নয়। জাপান তিমি ও ডলফিনজাত খাদ্য এবং পণ্যসামগ্রী বাজারজাত ও রপ্তানির মাধ্যমে অঢেল অর্থ আয় করে। ১৯৮২ সালে আন্তর্জাতিক হোয়েলিং কমিশন বাণিজ্যিক কারণে তিমি নিধন নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে জপান 'লোকাচার' এবং 'বিজ্ঞানের ও গবেষণার প্রয়োজনে' অজুহাতে নিস্কৃতি পেয়ে চলছিল। একপর্যায়ে দেশটি কমিশন ত্যাগ করে। স্কটল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসিত ফ্যারো দ্বীপে নৃশংস পাইলট হোয়েল ডলফিন হত্যা উৎসব এখনও বন্ধ হয়নি। দ্বীপরাজ্যটি আইন করে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ বন্ধ করেছে এবং দাবি করে চলেছে যে, তাদের নিধন পরিবেশসম্মত।
বাণিজ্য ও কাঁচা নগদের হাতছানির কারণে আফ্রিকায় পোচিং, বিশেষত হাতি এবং গণ্ডার নিধন থামছেই না। শুধু দাঁত এবং শিংয়ের উচ্চ বাণিজ্যমূল্যের কারণে প্রাণীগুলো প্রাণ দিচ্ছে। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় শিকারিরা মাইন পেতে হাতি নিধন করে। কিছু কিছু পাখি ও বিরল প্রজাতির প্রাণীর তেল ও হাড় জীবনীশক্তি ও যৌনশক্তিবর্ধক- এ ধরনের অবৈজ্ঞানিক লোককথা প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বময় প্রাণবৈচিত্র্যের কালোবাজার-ব্যাপ্তি বাড়িয়ে চলেছে চোরাচালানিরা। পাচারের প্রয়োজনে এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে তো বটেই, বাংলাদেশের বনাঞ্চল থেকেও লোকচক্ষুর অগোচরে হরিণ, বানর, কমোডো ড্রাগন, বিরল সরীসৃপ, গুইসাপ, বনরুই, ধনেশ পাখি, কাছিম ও খেঁকশিয়াল শিকার চালু আছে। পর্যটকদের পছন্দনীয় পাচারের তালিকায় ইউরোপীয় কমিশন উল্লেখ করেছে দক্ষিণ আমেরিকার তোতাপাখি, কাস্পিয়ান সাগরের জলজ প্রাণীদের ডিম, আফ্রিকার সরীসৃপ ইত্যাদির নাম। বিচিত্র এবং বিরল পাখি ও প্রাণী পুষতে আগ্রহী ব্যক্তি এবং চামড়া, শিং, খুলি ইত্যাদি বস্তুর শখের সংগ্রহকারীদের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে চোরাকারবারি পেশা এবং প্রাণবৈচিত্র্য উজাড়ীকরণ।
যেভাবেই হোক, মানুষ প্রাণিজগতের সংস্পর্শে আছেই। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, প্রতিদিনই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে প্রাণীদের সংস্পর্শে আসতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। তাই করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই প্রশ্ন এসেছিল পোষা প্রাণী কিংবা বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে করোনা বা অন্য কোনো রোগ ছড়াতে পারে কিনা? উহানের বনরুই থেকে করোনা ছড়ানোর যে সন্দেহ, সেটিরও এখনও সুরাহা হয়নি কেন? জুনোটিক ডিজিজেস বা প্রাণীবাহিত রোগ সম্পর্কেই বা আমরা কতটুকু জানি কিংবা জানি না কেন অথবা জানানো হয়নি কেন? মানবপ্রজাতি ও প্রাণিকুলের পরস্পর সম্পর্ক বিষয়েই বা আমরা কতটা জানি?
নানাভাবেই মানুষ ও প্রাণিজগতের সংস্পর্শ ঘটছে। কভিড সময়ে মানুষের ঘরবন্দিত্বকালে প্রকৃতির স্বরূপে ফেরা তেমন একটি উদাহরণ। বিগত মাসগুলোতে বিশ্বের বহু পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্রিক সমুদ্রসৈকতে লোকসমাগম না থাকায় লোকালয়ের কাছাকাছি চলে এসেছিল হাজার হাজার ডলফিনের পাল। সৈকতজুড়ে ডিম পেড়ে গেছে কচ্ছপেরা। লোকালয়ে চলে এসেছে হরিণ, বানর, খরগোস, বাঘডাশ, বনবিড়ালসহ নানারকম প্রাণী। কোথাও কোথাও ভালুকেরও দেখা মিলেছে। নানারকম দেখা-অদেখা পাখিরা ভিড় করেছে নগরের তরুলতা গুল্মেও। মানুষ, বিশেষত শিশুরা তাদের খাবার দিচ্ছে। দেহসংলগ্ন হচ্ছে। প্রাণীরাও মানবভীতি কাটিয়ে উঠছে। গৃহবন্দিত্বের একঘেয়েমি কাটাতে বিশ্বময় মানুষ পোষা প্রাণীর দোকান খালি করে পশুপাখি কিনেছে। দরিদ্র দেশগুলোতে ক্রেতার অভাবে দোকানিরা উপার্জন হারিয়ে নামমাত্র মূল্যে অভুক্ত ও অসুস্থ পশুপাখি বিক্রি করেছে। উঠতি শহুরে মধ্যবিত্তরা সেগুলো কিনে ঘরে তুলেছে। এভাবে প্রাণিজগতের সঙ্গে মানবজগতের যোগাযোগ ও সংস্পর্শ অনেক বেড়েছে। এই যোগাযোগও হয়তো বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে। প্রাণী থেকে মানুষে অসুখ ছড়াতে পারে। তাই প্রত্যাশা, এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস 'জীববৈচিত্র্য'-ভাবনামুখী জনস্বাস্থ্য গবেষণার সূত্রপাত ঘটাবে এবং প্রাণিজগতের জন্য অনাক্রান্ত প্রতিবেশ সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান দিবস হয়ে উঠবে।
অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয় : প্রাণবৈচিত্র্য

মন্তব্য করুন