করোনাক্রান্ত সংকট এবং জাতীয় ছুটির ভেতরে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে। চেয়ারম্যান ও দু'জন সদস্যকে সরিয়ে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গরজ বড় বালাই। অনেক দিন ধরে দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে প্রচণ্ড মন্দা ভাব বিরাজ করছিল। এ নিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছিল বিনিয়োগকারীদের ভেতর। সে জন্য নতুন কমিটি আখ্যায়িত করা হলো। অন্যথায় কমিটি একই; চেয়ারম্যান সদস্যের পরিবর্তন।
স্টক এক্সচেঞ্জ তথা পুঁজিবাজার দেশের শিল্পায়ন, অবকাঠামো গড়ে তোলা, এমনকি পরিষেবার জন্য মূলধন সরবরাহ করে। আইপিওর মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারী, সঞ্চয়কারীরা শেয়ার, বন্ড, ডিবেঞ্চারের জন্য আবেদন করে থাকেন। উদ্যোক্তারা যে টাকা পান, তার বিপরীতে সুদ দিতে হয় না। অবশ্য আবেদনকারীরা কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হিসেবে লাভ-লোকসানের ভাগীদার। সবচেয়ে বড় কথা, জনগণের কাছে রক্ষিত বা সঞ্চিত অর্থ রাষ্ট্রের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করা হয়। ব্যাংক শুধু চলতি মূলধন সরবরাহ করবে।
উদ্দেশ্য মহৎ- এতে কোনো দ্বিমত নেই। আসলে ঘটছে তো উল্টো। সব কর্মে ঋণ দিয়ে আসছে বাণিজ্যিক ব্যাংক। এতে লাখ কোটি টাকা ঋণখেলাপি হয়েছে। কেননা, ব্যাংক ঋণ নেওয়া হয় পরিশোধ না করার জন্য। প্রকল্পের প্রয়োজন যাচাই করে ঋণ দেওয়া হয় না; অন্য কিছু এর পেছনে কাজ করে। যারা বছরে গুটি কয়েক কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ করে থাকে। তাহলে শেয়ারবাজার এত জমজমাট হবে কীভাবে?
সবাই ৯৬ এবং ০৯-১০ সালের মার্কেটের সঙ্গে তুলনা করতে চায়। দু'বারই চক্রান্ত করায় শেয়ার মার্কেট অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে পরে পতন ঘটে। একটি চিংড়ি রপ্তানিকারী কোম্পানির একশ' টাকার শেয়ার যদি ২৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়, তাহলে সেটাকে উন্মাদনা ছাড়া আর কী বলা যায়! ফল হয়েছে এই যে, কিছু নিরীহ বিনিয়োগকারী সর্বস্ব হারিয়ে বিদায় নিয়েছেন শেয়ার মার্কেট থেকে। দু'বারই লক্ষ্য করা গেছে, এক শ্রেণির শেয়ার মার্কেট বিশেষজ্ঞ বাজারকে শান্ত করার পরামর্শ না দিয়ে আরও অর্থ জোগানের আহ্বান জানিয়েছেন; যেন আকাশ হলো মূল্য বৃদ্ধির সীমারেখা।
একে বলা যায় 'ফিন্যান্সিয়ালাইজেশন' মানসিকতা। এর উপযুক্ত বাংলা আমার জানা নেই। আবহমানকাল ধরে এটাই চলে এসেছে; অর্থ বিনিয়োগ করে ভোগ বা পরিষেবার জন্য সম্পদ সৃষ্টি করা হয়। আর ফিন্যান্সিয়ালাইজেশন হলো আর্থিক কৌশল প্রয়োগ করে সম্পদ বাড়ানো। এই সম্পদ রাষ্ট্র বা সাধারণ মানুষের কল্যাণে আসে না। পুঞ্জীভূত হয় কয়েক ব্যক্তির হাতে।
বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটকে সক্রিয় করার জন্য ঋণ প্রদানের ভূতটি ঘাড়ে চেপেছে। যে প্রতিষ্ঠান পুঁজি সরবরাহ করবে, তাকে যদি হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ দেওয়া হয়, তাহলে তো জিরো সাম গেম বলা চলে। শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা ঋণ নিয়ে থাকেন মার্চেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে। সেখানে নিয়মকানুন কড়া। খেলাপি হওয়ার সুযোগ কম। এভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্টাইলে শেয়ার কেনার ঋণ দেওয়া যায় না। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে শেয়ার কিনলে ঋণের ফাঁদ থেকে কখনও কেউ বেরিয়ে আসতে পারবে না। আমাদের পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে হলে প্রাথমিক মার্কেটের পরিধি বাড়াতে হবে। বারবার বলা সত্ত্বেও সরকারের কাছে যে শেয়ার রয়েছে, তা মার্কেটে আসছে না। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংককে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হলো। কিন্তু একটি শেয়ারও বাজারে ছাড়া হয়নি।
আইপিওতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আকৃষ্ট করতে সরকারের তরফ থেকে বেশ কিছু সযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনবোধে আরও বিবেচনা করা যেতে পারে। বিশেষ করে করোনা বিশ্বের অর্থনীতির আরও কত বিপর্যয় ঘটবে, তা বলা যাচ্ছে না। অতএব নিজেদের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের কথা মাথায় রাখতে হবে। একটি অভিযোগ করা হয় যে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কারও কারও অডিট রিপোর্ট ঠিকমতো করা হয় না। এখন তো সরকারের নিয়ন্ত্রণে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিএসইসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।
পরিস্থিতি যাই হোক, কয়েকটি বিষয়ে বিএসইসিকে দৃঢ় অবস্থানে থাকতে হবে। প্রথমত, কোনো সময় শেয়ারের মূল্য গগনচুম্বী হতে দেওয়া যাবে না। শেয়ারে যারা বিনিয়োগ করতে আসেন তারা নিজ দায়িত্বে আসেন, তাদের বাধ্য করা হয় না।
শেয়ারবাজারের উত্থান-পতন থাকবে। সেখানে কাউকে উদ্ধার করার জন্য সরকারি তহবিল থেকে অর্থ প্রদান করা ঠিক হবে না। সেটা হবে ক্ষমতার অপব্যবহার। শেয়ার ব্যবসায়ে যদি দুর্নীতি, অনিয়ম হয়ে থাকে সেটা দেখা ও ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার বিএসইসির আছে। বিএসইসির আর একটি কর্তব্য হলো যেনতেন অজুহাতে আইপিওতে প্রিমিয়ামের অনুমতি না দেওয়া। কিছু উদ্যোক্তা আছেন যারা সাধারণ বিনিয়োগকারীর কথা মোটেই ভাবেন না। এখন কতদিন জানি না, তবে ছিল যে প্রসপেকটাস প্রকাশের ৩ সপ্তাহ আগে স্টক এক্সচেঞ্জে অনুলিপি দেওয়া। আর স্টক এক্সচেঞ্জের দায়িত্ব বিনিয়োগকারীর স্বার্থে তা খুঁটিয়ে দেখা। যদি স্টক এক্সচেঞ্জের কোনো আপত্তি থাকে, তাহলে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে তা নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা। একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। কেন জানি না, আইপিওর মাধ্যমে মূলধন জোগাড়ের কালচারটা তেমনভাবে গড়ে উঠছে না। নতুন চেয়ারম্যান ও সদস্যরা বিষয়টিতে অধিক মনোনিবেশ করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
এখন শেয়ারবাজারে বুল বিয়ারের আগমন-নির্গমন ঘটবে। মাঝেমধ্যে অস্থিরতা দেখা দেবে। তবে ভয়াবহ শেয়ার কেলেংকারি হওয়ার আশঙ্কা নেই। যদি না বিএসইসি কিংবা ডিএসই অতিমাত্রায় উদাসীন না হয় এবং কানকথা না শোনে।
ব্যাংক, বীমা খাত, শেয়ারবাজার বিশ্নেষক ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা