
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম দেখে অর্ধশতক আগের একটি স্মৃতি আমাদের আলোড়িত করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটিতে কারফিউ ভঙ্গ চলছে। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিককে পুলিশ হত্যা করেছে। জর্জ ফ্লয়েড নামক এই কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিককে এমনভাবে পুলিশ হেফাজতে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেছে যে, সমগ্র আমেরিকা তাতে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। ফুঁসে ওঠার আরেকটি বড় কারণ ঘটেছে যার হোতা স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটনে একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ এবং পুলিশি ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি সেনাবাহিনী নামানোর হুমকি দিয়েছেন। এই হুমকিতে আমেরিকার সিভিল সোসাইটি, ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ মানুষও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তারা কল্পনা করতেই পারেন না যে, আমেরিকার রাস্তায় আমেরিকারই সশস্ত্র বাহিনী ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। যদিও আমেরিকার নাগরিকরা ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানসহ নানা দেশে এসব দৃশ্য দেখেছেন। কেউ কেউ প্রতিবাদও করেছেন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় নাগরিকদের একটা বিরাট অংশ তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে সংকটের ঘটনা নতুন নয়। মার্কিন লুথার কিং নিহত হলেন। তারপর ১৯৯২ সালে রডনি কিং নামে এক কৃষ্ণাঙ্গকে প্রকাশ্যে পুলিশি নিপীড়নের শিকার হতে হয়। সে নিয়ে সারা আমেরিকায় প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছিল। আমি তখন নিউইয়র্কে ওইদিনই আমার লস অ্যাঞ্জেলেস যাওয়ার কথা। তখন টিকিট রি-কনফার্ম করতে গিয়েছি ম্যানহাটনে। এক শ্বেতাঙ্গ নারী কাজ করছিলেন। কাঁপতে কাঁপতে উঠে গেলেন এবং টেলিভিশনের দিকে তাকাতে বললেন, দেখলাম শুধু লস অ্যাঞ্জেলেস নয়, সারা আমেরিকাতেই আগুন জ্বলছে। আমরা এয়ারলাইন্স অফিস থেকে তখনও বেরোইনি, ম্যানহাটনে বিশাল বিক্ষুব্ধ মিছিল বেরিয়ে গেল। আমরা বাংলাদেশের মানুষ এসব বিক্ষোভ মিছিল পরোয়া করি না। এয়ারলাইন্স অফিস থেকে আস্তে ধীরে বেরিয়ে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের পেছন পেছন হাঁটতে থাকলাম। লস অ্যাঞ্জেলেসের বন্ধুদের জানিয়ে দিলাম। কিন্তু উদ্যোক্তারা এও জানালেন, কালকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে, আপনি কাল আসুন। সে যাত্রায় আর যাওয়া হয়নি। তবে তখনকার প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ অত্যন্ত সুকৌশলে বিষয়টি আয়ত্তে এনেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন ৯/১১ হলো, তখনও আমি নিউইয়র্কে। বুশপুত্র জুনিয়র বুশ তখন প্রেসিডেন্ট। উত্তেজনার মুহূর্তে বলে ফেললেন, ক্রুসেড শুরু হয়ে গেছে। ফলে মুসলমানদের ওপর চড়াও হলেন। সে সময় নিউইয়র্কের মেয়র জুলিয়ানি পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। গত আট দিন ধরে বিক্ষোভ চলছে। কোথায় গিয়ে থামবে তার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে করোনায় সবচেয়ে আক্রান্ত দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। সামাজিক দূরত্ব কেউ মানছে না। ঘরে থাকার নির্দেশও টিকছে না। তাতে সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনাও প্রচুর। সব অর্থেই এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেপরোয়া। এবারে আবার কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাপক শ্বেতাঙ্গ মানুষ। প্রতিটি শহরেই চলছে বিক্ষোভ। এই মাত্র সিএনএনে দেখা গেল, লস অ্যাঞ্জেলেসে এক শ্বেতাঙ্গ যুবক স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার বরণ করছে। করোনাভাইরাস সাম্রাজ্যবাদের জন্য একটা সুবিধা এনে দিয়েছিল। শারীরিক বিচ্ছিন্নতার বদলে তারা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা শব্দটি ব্যবহার করেছিল। সমাজ যাতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে সে জন্য এই শব্দের প্রয়োগটি যথার্থই হবে। শো বলেছে, সভা-সমাবেশে যাওয়া যাবে না। কোনো স্পর্শ করা যাবে না ইত্যাদি। কিন্তু পুলিশ যখন পিঠমোড়া দিয়ে ধরে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তা কী দাঁড়ায়? নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, এমনকি শান্তিপূর্ণ তারকাদের শহর হলিউডেও গ্রেপ্তার চলছে অবিরাম। লেখাটা শেষ হতে না হতেই সেনাবাহিনী নেমে পড়েছে ওয়াশিংটনে। হোয়াইট হাউসের আশপাশে শত শত সেনা মোতায়েন হয়েছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে একসময় নানাভাবে মদদ জোগাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু নিজের দেশই যখন উগ্রপন্থিদের দ্বারা আক্রান্ত হলো, তখন থেকেই একটু পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই গির্জায় না ঢুকে বাইবেল দেখালেন। এতেও ধর্মীয় নেতারা যথেষ্ট ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। এবার একটি ব্যতিক্রমী চিত্র দেখা গেল। কোনো কোনো রাজ্যে, বিশেষ করে ফ্লোরিডায় পুলিশরা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে নিহতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে সবসময়ই একটা অখণ্ড জাতির আশঙ্কা ছিল; কিন্তু বর্ণবাদের রোগটা কিছুতেই সারছে না।
নেলসন ম্যান্ডেলার মতো নেতার উন্নয়ন হওয়ার পর সারাবিশ্ব স্বপ্ন দেখেছিল একটি বর্ণবাদী পৃথিবীর। সেই সঙ্গে ধর্মের ভিত্তিতে মানবজাতি বিভক্ত হোক, হিংসার উন্মত্ত হোক। এর পুনরাবৃত্তি আর হবে না। কিন্তু দুটি দুই বৃহৎ দেশে ফিরে এসেছে। এর মধ্যেই এসেছে ঘাতক ব্যাধি মহামারি করোনা। সে বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধনী-দরিদ্র মানে না। অনায়াসে লাখ লাখ প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু যে বোধোদয় আমরা আশা করেছিলাম, তা একেবারেই দৃশ্যমান নয়। আমেরিকার বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ বেশ কিছু দিন ধরে ভারতে নাগরিকত্ব আইন ভেতর থেকে আবার মাথা তুলতে শুরু করেছে। একদিকে পৃথিবী বিপন্ন, অন্যদিকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, ব্যাপক বেকারত্ব খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রবল আকার ধারণ করেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিষয়গুলো আরও ভয়াবহ। তিন মাস হয়ে গেল, আরও কতদিন যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা মেলেনি। শাসকগোষ্ঠীর হাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নড়বড়ে, কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এতটাই প্রস্তুতিহীন যে আগে কখনও বোঝা যায়নি। জনস্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা এখনও প্রকট। জনস্বাস্থ্য বলে যে একটা গুরুতর বিষয় আছে, তা আমলেই আনা হয়নি। চিকিৎসকরা যতটা জরুরি ও দৃশ্যমান রোগের সেবায় নিয়োজিত, যাতে করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস ফুলে ফেটে ওঠে, সেদিকেই গুরুতর মনোযোগ দিয়েছেন। যার ফলে বিশাল বিশাল বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক গড়ে উঠেছে; কিন্তু জনস্বাস্থ্যের প্রতি ততটাই অবহেলা সরকারের। দেশের একটা জেলা শহরে শতাধিক ক্লিনিক রমরমা ব্যবসা করে চলেছে। ব্রিটিশ আমলে পাবলিক হেলথ, বাংলায় যা দাঁড়ায় জনস্বাস্থ্য- তার দিকে প্রবল অবহেলা। দেশভাগের পর মানে পঞ্চাশ বা ষাটের দশকেও আমরা গ্রামে ডিসপেনসারি দেখেছি। কিন্তু সিরাপ ও বড়ি দিয়ে চিকিৎসা চলছে। একজন কম্পাউন্ডারই ডাক্তার হিসেবে বিবেচিত হতেন। সারা থানায় দুই-তিনটি ওষুধের দোকান। এসবের উন্নয়ন লক্ষণের ব্যবস্থা দেখা গেল একসময়। সেসব বন্ধ হয়ে গেল। ব্রিটিশ আমলে চিকিৎসকদের একটা শর্ট কোর্স দিল এলএমএফ। তিন বছরের কোর্সে পাস করে এসে এরা ছড়িয়ে যেতেন গ্রামগঞ্জে। একসময় সেটি বন্ধ হয়ে গেল। তার স্থলে এমবিবিএস ডাক্তার এলেন। কোর্সটি রেখেও বড় কোর্স রাখার চেষ্টা করা যেত। বড় ডাক্তার ও ছোট ডাক্তার দ্বন্দ্বের এভাবেই মীমাংস হয়ে গেল। ওই সময় এলএমএফ ডাক্তারদের সঙ্গেই সাধারণ মানুষ চিকিৎসা নিত। সেই সঙ্গে ছিল শক্তিশালী গ্রামীণ সমাজের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। মানুষের অভিজ্ঞতা হাজার বছরের স্বাস্থ্যজ্ঞান, এসব ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। এখন বড় ডাক্তার, বড় হাসপাতালের সমার্থকই হচ্ছে বড় টাকা। আবার বাড়িঘর বিক্রি করে দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার আকাঙ্ক্ষা। সরকারি হাসপাতালের বদলে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হবে। করোনার চিকিৎসা নিতে গিয়েও বেসরকারি হাসপাতালের প্রায় সর্বস্বান্ত হওয়ার মতো অবস্থা। চিকিৎসার পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থায় কোথা থেকে আসবে? করোনার বাইরের রোগীদেরই-বা কী হবে? এসব নিয়ে সমন্বিত কোনো ব্যবস্থাও গড়ে উঠছে না।
ভাবা হয়েছিল, করোনা যেহেতু সর্বগ্রাসী মহামারি, তাই মানবজাতি ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একটা মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলবে। শ্রেণিহীন সে পৃথিবীর স্বপ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। আমাদের দেশেও ব্যবসায়ীরা নিষ্ঠুর। জনপরিবহন, চিকিৎসা, খাদ্যদ্রব্য সবকিছুতেই মুনাফার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তাদের ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ চুরি করতেই বাধে না। মুনাফার ক্ষেত্রে মানব জীবনকে এরা পরোয়া করছে না। লিবিয়াতে ২৬ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হলো। এই হত্যার কারণ এবং নায়করা দেশের মাটিতেই আছে। একজন জর্জ ফ্লয়েডের জন্য সারা পৃথিবী টালমাটাল হয়ে গেল আর এমনি ২৬, ১০০, ২০০ মানুষের জীবনের জন্য সংবাদমাধ্যম ছাড়া কোনো প্রতিবাদ নেই। এও এক ভয়ংকর করোনা দেশে ঘুরে ফিরছে। এ থেকেও মুক্তি চাই, যার জন্য প্রয়োজন প্রতিবাদ। সঠিক শিক্ষা থেকে মেরুদণ্ডওয়ালা মানুষের প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদের মানুষ এখনও আমাদের দেশে আছে।
নাট্যব্যক্তিত্ব
মন্তব্য করুন