আবার এসেছে ১১ জুন। ২০০৭ সালের এই দিন ২৪ ঘণ্টা ৪২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে চট্টগ্রামের ন্যাড়া, অসুস্থ, ক্ষতবিক্ষত পাহাড়গুলোতে ধস নেমেছিল। চট্টগ্রামের সেনানিবাস এলাকা, সেনা লেডিস ক্লাব, কাছিয়াঘোনা, ওয়ার্কশপঘোনা, শহরের কুসুমবাগ, মতিঝর্ণা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ প্রায় সাতটি এলাকায়। ভোরবেলা সামান্য সময়ের ব্যবধানে নারী, বৃদ্ধ, শিশুসহ ১২৭টি প্রাণের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। প্রায় সবাই ছিল কাটা পাহাড়ের ঢালে জীবন হাতে নিয়ে বাস করা বস্তিবাসী। শ্রমিক, বানেভাসা জলবায়ু উদ্বাস্তু, অসহায় মানুষ।
এর পর ধারাবাহিকভাবে প্রায় ১৩ বছর আমরা অতিক্রান্ত করেছি। বিচ্ছিন্ন দু'এক বছর বাদ দিয়ে প্রতিবছরই কোনো না কোনোভাবে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটেছে। এ পর্যন্ত এ রকম মৃত্যু প্রায় চার শতাধিক। নির্মম নিয়তিনির্ভর ঘটনা মনে করে আমাদের নীরবতা নির্লিপ্ততায় রূপ নিয়েছে।
ছিন্নমূল, বানেভাসা, নদীভাঙা, জলবায়ু তাড়িত, ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষগুলো ভূমিদস্যুদের খপ্পরে পড়ে পাহাড়খেকো লোভী মানুষের লোভের উপাদানে পরিণত হয়ে পাহাড়ে বসবাস শুরু করে। অভাবে, স্বভাবে, লোভে তাড়িত হয়ে এরা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে বসতি গড়ে। সামান্য ভাড়ার বিনিময়ে জীবনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে।
চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোতে বালির পরিমাণ বেশি। ২০০ মিলিমিটারের ওপরে ধারাবাহিক বৃষ্টিপাত হলেই এই কাটাছাঁটা, ন্যাড়া, পঙ্গু, বিকলাঙ্গ পাহাড়গুলোতে ভূমিধস হয়। আগেই বিভিন্ন অনিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পাহাড়গুলোকে কাটা হয়, ছাঁটা হয়, ধসের উপযোগী করে রাখা হয়। পাহাড়দস্যু বা ভূমিদস্যুদের পাহাড় দখলের এই প্রক্রিয়াটি অতি পুরোনো। এভাবেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রায় শতাধিক পাহাড় মোচন, কাটাকাটি, ছাঁটাছাঁটি প্রভৃতি অপকর্মে অস্তিত্ব সংকট নিয়ে বিলীন হয়েছে অথবা পঙ্গুত্ববরণ করে অস্তিত্ব হারানোর ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।
২০০৭-এর মর্মান্তিক পাহাড় ধসের পর তাৎক্ষণিকভাবে যে কমিটি গঠন করা হয়, তা ২৮টি কারণ উলেল্গখ করে, ৩৬টি সুপারিশের একটি খসড়া প্রণয়ন করে- পাহাড়দস্যুদের চিহ্নিত করা, পাহাড়ে বসতি উচ্ছেদ করে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া, পাহাড় কাটাছাঁটা বন্ধ করা প্রভৃতি। এ যাবৎ ওই কমিটি বছরে কদাচিৎ পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে। পর্যালোচনা, আলোচনা যা হওয়ার তা হয়েছে। সময় গড়িয়েছে। ঘুরে ঘুরে বছর এসেছে। প্রশাসন বলতে যা বোঝায়, তা বছরের দশ মাস নিবিড় নীরবতা পালন করে। আমলা আসে, আমলা যায়। কেউ কেউ একাধিকবারও এসেছে-গেছে। পাহাড় বিলীন হওয়ার প্রক্রিয়াটি থেমে থাকেনি। ৩৫ দফা সুপারিশমালাও খসড়াই থেকে গেছে।
বিগত সময়গুলোতে চট্টগ্রামের পাহাড়ের অবস্থা আরও সঙ্গিন ও বিপজ্জনক হয়েছে। পাহাড়ে বস্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাহাড়দস্যুদের সংখ্যা, ক্ষমতার দাপট এবং অপতৎপরতা আরও বেড়েছে। পাহাড়ের সবুজের বৈভব, প্রাকৃতিকতা আরও লীন হয়েছে। পাহাড়ের দেহ ধারাবাহিকভাবে লুট হয়ে চলেছে। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর বিবর্তন ঘটেই চলেছে। যেমনটা অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী নদীর ক্ষেত্রে ঘটে যাচ্ছে।
চট্টগ্রামের পরিবেশ নান্দনিকতার অন্যতম উপকরণ-উৎস, সবুজ, সবল, দৃষ্টিনন্দন পাহাড়। গত প্রায় দুই যুগ ধরে পাহাড়ের ওপর যে অত্যাচার চলে আসছে, তাকে যেন কোনোভাবেই নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। পাহাড় বিপর্যয় বিভিন্ন সময়ে খবরের শিরোনাম হলেও মৃত্যুফাঁদ হয়ে মানুষের জীবন সংহার করে চলেছে। সরকারি তৎপরতাকে ঈদের নতুন চাঁদ অথবা রংধনুর রঙের মতো খুবই ক্ষণস্থায়ী মনে হয় ভুক্তভোগী মানুষের কাছে।
পরিবেশের ভারসাম্য উপাদান পাহাড়কে সুরক্ষিত করার প্রক্রিয়া নিঃশেষ হতে দেওয়া যাবে না। পাহাড় ধসের মামলা পরিচালনার দায়িত্বে অবহেলার মানসিকতা নির্মূল করতে হবে। পরিবেশ রক্ষা বোধের চেতনা থেকে দায়িত্বে অবহেলার মানসিকতা মুছে ফেলতে হবে। আমলাতান্ত্রিকতায় পেশাদারিত্ব দৃশ্যমান রাখতে হবে। দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের অব্যাহত নজরদারি, পরিবেশ আইনের শতভাগ প্রয়োগ, আদালতের সরব উপস্থিতি, কঠোর এনফোর্সমেন্ট অভিযান প্রভৃতির পাশাপাশি পাহাড়ে বৃক্ষরোপণ, পাহাড়ের মাটি সংরক্ষণ, প্রয়োজনমতো গাইডওয়াল নির্মাণ করে পাহাড়কে সুরক্ষিত করার প্রক্রিয়াকে দৃঢ় দৃশ্যমান করতে হবে।
পাহাড়ধস এক রাতে হয় না। প্রতিটি দিন ও রাতেই পাহাড়কে সুরক্ষা দিতে হবে। এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলের ক্ষতবিক্ষত, পঙ্গু পাহাড়গুলোকে চিহ্নিত করে আগ্রাসীদের একটি পরিচিতি জনসমক্ষে তুলে ধরা দরকার।
বছর ঘুরে এলে মে, জুন কিংবা জুলাই মাসে আমরা শুনতে পাই 'আপনারা পাহাড় থেকে নেমে আসুন, আপনাদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, আপনারা জীবনের ঝুঁকি নেবেন না' ইত্যাদি। আমাদের দুর্ভাবনা বেড়ে যায়। পাহাড়ের বিলাপ আকাশে-বাতাসে আন্দোলিত হয়। শত শত মৃত্যুপ্রাণ আমাদের ধিক্কার দেয়। করোনার এই বিশ্ব মারিকালে পাহাড় আর কোনো বিপর্যয়ের বিভীষিকা বয়ে না আনুক- এই প্রত্যাশা।
মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষক, কর্ণফুলী গবেষক
মন্তব্য করুন