- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- চিকিৎসাবিহীন মৃত্যু ও প্রতিকারহীন চিৎকার
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
চিকিৎসাবিহীন মৃত্যু ও প্রতিকারহীন চিৎকার

আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নানা অসঙ্গতি, চিকিৎসাকেন্দ্রিক বাণিজ্য, স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা কোনো কিছুই নতুন নয়। বিনা চিকিৎসায় প্রাণহানির দৃষ্টান্তও অনেক আছে। কিন্তু করোনা-দুর্যোগকালে উল্লিখিত বিষয়গুলো আরও প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়েছে। চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির বিষয়টি যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়তিনির্ভর। দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা পরিধির বিস্তৃতি ঘটেছে সত্য; কিন্তু এর সমান্তরালে বেড়েছে চিকিৎসা সেবার নামে নগ্ন বাণিজ্য এবং অপকৌশল। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে জীবন দিয়ে মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে কোনো রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালের (সরকারি-বেসরকারি) দরজায় দরজায় ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মরে যাওয়ার বিষয়টিকে কেন নিয়তি বলে মেনে নেব? চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি নাগরিকের মৌলিক অধিকার হওয়া সত্ত্বেও এমন মর্মন্তুদ ঘটনা বিগত তিন মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কম ঘটেনি। সংবিধান স্বীকৃত এই অধিকারের বেহাল অবস্থা যে কেবল এই করোনা-দুর্যোগকালেই ফুটে উঠেছে তাই নয়, চিকিৎসাবঞ্চিত কিংবা চিকিৎসার নামে বাণিজ্যিকীকরণের আগ্রাসনে রোগীর প্রাণহানির দৃষ্টান্তও কম নেই। এই করোনা-দুর্যোগকালে চিকিৎসা সেবাদানে মানবিকতার বিষয়টি উল্লেখ করার পাশাপাশি এও বলতে চাই, বিষয়টি শুধু মানবিকতায় গণ্ডিবদ্ধ রাখার অবকাশ নেই। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার বিষয়ের পাশাপাশি ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির প্রসঙ্গও সামনে চলে আসে। করোনা উপসর্গে যেমন, তেমনি অন্য ব্যাধিতে আক্রান্তদের চিকিৎসা না পাওয়া সংক্রান্ত হৃদয়বিদারক খবর ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে কম উঠে আসেনি।
গত ক'দিনে সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে যা খবর বেরিয়েছে তার কয়েকটি শিরোনামই যথেষ্ট। যেমন- 'দুর্যোগেও বাণিজ্যেই চোখ বেসরকারি হাসপাতালের' (সমকাল, ৬ জুন), 'দুর্যোগের সুযোগে চিকিৎসা উপকরণ ও ওষুধের রমরমা ব্যবসা' (সারা বাংলা ডটকম, ৪ জুন), 'হাসপাতাল খালি তবুও মরছে মুমূর্ষুরা' (কালের কণ্ঠ, ৭ জুন), 'বেসরকারি হাসপাতালে করোনা বাণিজ্য রমরমা' (দেশ রূপান্তর, ৫ জুন), 'কানে তালা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর' (দেশ রূপান্তর, ১৫ মে), 'খরচ বহন করতে হবে রোগীকেই' (সমকাল, ৩০ মে), 'বেসরকারি মেডিকেলের দাবি আকাশচুম্বী' (সমকাল, ১৮ মে), 'হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে' (প্রথম আলো, ৪ জুন)। এই তালিকা অল্প কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।
করোনা-দুর্যোগ যে বা যাদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে এর মধ্যে উপরোক্ত তালিকার পাশাপাশি ত্রাণ নিয়ে অনিয়মকারী একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধি এবং সরকারের অসাধুরা যেমন রয়েছেন একই সঙ্গে গজিয়ে উঠেছে সুযোগসন্ধানী আরও কিছু চক্র। এত প্রচেষ্টার পরও স্বাস্থ্য খাতে বিরাজমান অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারীদের দুর্বৃত্তপনা ঠেকানো যায়নি বিধায়ই জনবিড়ম্বনা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠেছে। একেক সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত অনভিপ্রেত ঘটনার যেসব চিত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে এর সিংহভাগই থেকে গেছে প্রতিকারহীন। এই যে বিনা চিকিৎসায় ঘুরে ঘুরে যারা প্রাণ হারালেন তাদের এমন মৃত্যুর কোনো প্রতিকার কি হয়েছে? রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলরা বলছেন, এমন ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যাদের কারণে এমন মর্মন্তুদতার সৃষ্টি তারা অস্পর্শই থেকে গেছেন। প্রতিকারহীনতার কি উৎকট চিত্র।
আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে সত্য কিন্তু সদিচ্ছা কিংবা দায়বদ্ধতা আছে কতটা? এ প্রশ্নের জবাব প্রীতিকর নয়। আমরা জানি, করোনা সংক্রমণের কারণে শুধু বাংলাদেশই নয়, প্রায় গোটা বিশ্বই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। যেহেতু ব্যাধিটি সংক্রামক, সেহেতু এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। একই সঙ্গে আরও কিছু সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা ইউনিটও স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমতাবস্থায় অন্য ব্যাধিক্রান্ত রোগী কেন চিকিৎসাসেবা পাবেন না? উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দেশের অনেক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অন্য ব্যাধিতে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে এই ক্রান্তিকালে নানারকম কসরত ও বাণিজ্য ফন্দি এঁটে চলেছে। নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত গর্হিত। ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে সৃষ্ট এই অবস্থা দিনের পর দিন চলতে পারে না। যেহেতু এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির শেষ কোথায় কেউ বলতে পারছেন না। সেহেতু এ অবস্থায় প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসার মেলবন্ধন। কিন্তু তা না হয়ে সেখানে পরিলক্ষিত হচ্ছে তুঘলকি কাণ্ড এবং আরও বিস্ময়কর হলো, এর কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য-দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার নেই। যেসব সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে, শর্ত অমান্য করছে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতেই হবে। করোনা-দুর্যোগের এ সময়ে অন্তত আগামী ২ মাসের জন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলো 'লাভ নয় লোকসান নয়' ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হোক। চিকিৎসা-বাণিজ্য তো তারা কম করেনি। আরও করবে। এখন ক'টা দিন বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ না হয় চলুক প্রকৃতার্থে সেবার মনোভাব নিয়ে।
আমাদের দেশে চিকিৎসাসেবা গ্রহীতাদের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির ব্যাপক তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। করোনা-দুর্যোগ তা আরও স্পষ্ট করল। এখানে বরাবরই রোগীর স্বার্থ উপেক্ষিত, ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই যেন মুখ্য। কিন্তু তা তো হতে পারে না। এর নিরসন ঘটাতে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিনা চিকিৎসায় প্রাণহানি কিংবা যথাযথ চিকিৎসা সেবা দেওয়া না হলে সংশ্নিষ্ট বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের লাইসেন্স বাতিলের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল সরকারের তরফে। এর বিপরীতে বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য- এই হুঁশিয়ারি কোনো সমাধান নয়। তাদের দাবি, সরকার শুরু থেকেই নির্দিষ্ট গাইডলাইন নিয়ে এগিয়ে এলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এখন বাহাসের সময় নয়। নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানবিক দায়িত্ব পালন, মানবিকতার প্রতিফলন ঘটানো দরকার। মুনাফার লোভ ত্যাগ করে সেবার মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ জরুরি। করোনাভাইরাস যাদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে, তারা মানবতা ও মানুষের মিত্র নয়। রোগীদের ভোগান্তি বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ভিন্ন গত্যন্তর নেই। একই সঙ্গে দেশের বিরাজমান বাস্তবতায় চিকিৎসা ব্যয়ের ব্যাপারে একটা হার নির্ধারণ করে দেওয়াও জরুরি।
হাসপাতাল কিংবা যে কোনো চিকিৎসা কেন্দ্রের দরজা থেকে রোগীকে ফেরত দান নিশ্চয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলরা যেন তা ভুলে না যান। করোনা-দুর্যোগ নতুন করে দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলোর গভীরতা কত গভীর। স্বাস্থ্য খাতের বঞ্চনা দশকজুড়েই বেড়েছে। জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে ব্যক্তি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কেন উচিত নয়, তাও বুঝতে বাকি রইল না। মানুষের মৌলিক অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে রেখে সংস্কারে হাত দিতে হবে। তবে তা যেন সড়ক-মহাসড়ক সংস্কারের মতো না হয়।
লেখক ও সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
মন্তব্য করুন