দীর্ঘ প্রায় এক বছর সেনাসমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনা শেরেবাংলা নগরে সাব-জেলে বন্দি থাকার পর ২০০৮ সালের ১১ জুন মুক্তিলাভ করেন। ১৯৮১ সালে দেশের বাইরে নির্বাসিত জীবনযাপনকালে তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি দলের দায়িত্ব নেন। দেশে তখন জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন চলছিল। এরপর দীর্ঘ চার দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সময়ে কমপক্ষে ২২ বার তাকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী ও উগ্র-জঙ্গিগোষ্ঠী কর্তৃক। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। হামলার মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। চট্টগ্রামে জনসভা করতে গিয়ে তিনি হামলার শিকার হন। সেখানেও বহু নেতাকর্মীকে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। এছাড়াও নানাভাবে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।

১৯৯০ সাল থেকে আমাদের দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হয়ে আসছিল। নির্বাচনোত্তর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৯০ সালে ছিল বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বেশ কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বিএনপি এককভাবে ভোটারবিহীন একটি নির্বাচন করেছিল। সব দল সে নির্বাচন বর্জন করেছিল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ৫ বছর সরকার পরিচালনার পর ২০০১ সালে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় আসার পর তারা দেশব্যাপী সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বিএনপি জোট বুঝতে পেরেছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তখন তারা একটি অনৈতিক, অসাংবিধানিক ও দেশপ্রেম বিবর্জিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। তারা নিজেদের শাসন অব্যাহত রাখার জন্য ২০০৪ সালে সংবিধানে চতুর্দশ সংশোধনী আনে। যার মূলে ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ওই সংশোধনীতে বিচারপতিদের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল বিএনপির এক সময়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক কে এম হাসান (যিনি পরবর্তীকালে বিচারপতি হয়েছিলেন) যাতে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হন। তা না হলে তার পরে আরেকজন বিচারপতি অবসরপ্রাপ্ত হবেন এবং সংবিধান অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন।

এখান থেকেই রাজনৈতিক সংকট ও সহিংসতার ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত হানে। তখন মানুষ ফুঁসে উঠে এবং আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের তোপে কে এম হাসান দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করলে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ আইন লঙ্ঘন করে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওই সময় একটি নির্বাচনের তারিখও ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা না বলে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন হাওয়া ভবনের তারেক রহমানের নির্দেশক্রমে। ফলে চারজন উপদেষ্টা এসব কার্যক্রমের বিরোধিতা করেছিলেন। তখন আন্দোলন আরও তীব্র হয়। আন্দোলনের মুখে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জেনারেল মইন উ আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী অঘোষিতভাবে ক্ষমতা দখল করে। পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ফখরুদ্দীন আহমদ। তবে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল সেনাশাসনের মুখোশ মাত্র। এ সরকার ক্ষমতায় এসেই সামরিক শাসকদের মতো পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা শুরু করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সেনাশাসনকে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিরাজনীতিকীকরণ। এরই অংশ হিসেবে তারা মাইনাস টু থিওরি সামনে আনে এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তারা এটা ভাবতে ভুলে গিয়েছিল যে, বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ সময়ের জন্য সামরিক শাসনকে প্রশ্রয় দেয় না। জনগণের আন্দোলনে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে সেনাসদস্যরা ছাত্রদের ব্যাপক প্রহার করে। ওই সময় আমি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ছিলাম। আমরা বিপন্ন ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম। এই অপরাধে আমাকেসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. সাইদুর রহমান ও বর্তমান ভিসি আব্দুস সোবহানসহ ১০ জন অধ্যাপককে গ্রেপ্তার করা হয়। ছাত্রদের নির্যাতন ও শিক্ষকদের গ্রেপ্তারের পর সারাদেশ ফুঁসে উঠেছিল। বলা যেতে পারে, সেনাসমর্থিত সরকারের পতনের ক্ষেত্রে এটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। তখন তারা নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে আজম চৌধুরী নামের এক ব্যবসায়ী তিন কোটি টাকার চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার আসামি করে ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রমও শুরু করা হয়েছিল। তখন গোটা দেশে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাপরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৯ সাল থেকে ১১ বছর ধারাবাহিকভাবে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আছে। আজ বাংলাদেশ উন্নয়নে বিশ্বের রোলমডেল। সবাই বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগে তিন হাজার তিনশ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। বর্তমানে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কাজ চলছে। সেখান থেকেও দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।

আমাদের কোনো শিক্ষানীতি ছিল না। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে সর্বসম্মতভাবে একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রবর্তন হয়েছে। আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি হয়েছে। গত ১১ বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধির হারও এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর চেয়ে বেশি। শেখ হাসিনা ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও কয়েকটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করেছেন। বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা পয়সায় ৩৫-৩৬ কোটি বই তুলে দিচ্ছেন। তিনি গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছেন। একশ'টি অর্থনৈতিক জোন গঠনের কাজ চলছে, বেশ কিছু সড়ক ইতোমধ্যে ফোর লেনে উন্নীত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ৫৭তম দেশ হিসেবে মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মর্যাদা লাভ করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। ভারতের সঙ্গে ছিটমহল নিয়ে আমাদের দীর্ঘদিনের যে সংকট ছিল তা সমাধান করেছেন শান্তিপূর্ণভাবে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে যে সমস্যা ছিল তারও সমাধান হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দশটি মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী ট্যানেল, পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ চলছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিশ্বব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি, যা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে নতুন করে তুলে ধরেছে।

১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় রাজনীতির হাল ধরেছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন, কারাবরণ করেছেন- এতসব সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। ২১০০ সালে বাংলাদেশের অবস্থা কী হবে তিনি এ বিষয়েও ডেল্টা প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। শেখ হাসিনা শুধু আওয়ামী লীগ প্রধান বা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন। তিনি বঙ্গবন্ধুর রক্তের ও আদর্শের উত্তরাধিকারী। তিনি ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার রূপকল্প হাতে নিয়েছেন। তিনি যে ভিত্তি রচনা করেছেন তাতে নিঃসংকোচে বলা যায়, বঙ্গবন্ধু হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের নির্মাতা আর শেখ হাসিনা হলেন আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা। শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবসে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করার পাশাপাশি তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়