সন্দেহ নেই যে, করোনা মোকাবিলার বিপুল কর্মযজ্ঞ সরকারের একার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। চিকিৎসাসেবা, ত্রাণ কার্যক্রম, সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিয়ে বেসরকারি বিভিন্ন পক্ষেরও সাধ্যমতো এগিয়ে আসার বিকল্প নেই। বস্তুত এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও বিস্তারের শুরু থেকেই আমরা এ ব্যাপারে তাগিদ ও উৎসাহ দিয়ে এসেছি। আমরা বলেছি, নাগরিকদেরও উচিত যার যার অবস্থান থেকে স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে করোনা মোকাবিলায় অবদান রাখা। আমরা দেখেছি, সম্পূর্ণ নতুন ও সর্বব্যাপ্ত এই ভাইরাস মোকাবিলায় সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে প্রায় পাল্লা দিয়ে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। আমাদের দেশেও ত্রাণ, চিকিৎসা ও সুরক্ষা উপকরণ বিতরণে স্বেচ্ছাশ্রমের অনেক নজির আমরা দেখেছি। তারপরও নাগরিকদের দিক থেকে আমরা আরও বেশি সক্রিয়তা প্রত্যাশা করছিলাম মূলত ব্যক্তিগত পর্যায়ে। নিজে যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে, অন্যকে মানার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করবে। কিন্তু আমরা কি তখনও ভাবতে পারিনি যে, করোনা মোকাবিলায় অন্যকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উৎসাহ রীতিমতো উৎপীড়নের রূপ গ্রহণ করতে পারে! নোয়াখালীতে একদল 'স্বেচ্ছাসেবী' যেভাবে করোনা মোকাবিলার নামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, তাতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- আমরা কি নাগরিকদের কাছ থেকে এই 'স্বেচ্ছাসেবা' চেয়েছিলাম? করোনা মোকাবিলায় তাদের 'অবদান' দেখে বহুল প্রচলিত বাংলা প্রবাদের সুর ধরে যেন বলতে হয়- করোনা মোকাবিলা চাই না, স্বেচ্ছাসেবক সামলাও।

সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, নোয়াখালীর সদর ও বেগমগঞ্জ উপজেলার কিছু এলাকা 'রেড জোন' ঘোষণা করে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ বা লকডাউন বাস্তবায়ন শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন। প্রশাসনের সঙ্গে স্বউদ্যোগে যোগ দেয় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী। সমকালে প্রকাশিত আলোকচিত্রে সেখানে স্থানীয় একজন সংসদ সদস্যকেও দেখা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত আমরা আপত্তির কিছু দেখি না। দেশের অন্যান্য এলাকাতেও এর আগে লকডাউন বাস্তবায়নে প্রশাসনের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা যোগ দিয়েছেন। সীমিত পরিসরে কর্মক্ষেত্র ও গণপরিবহন খুলে দেওয়ার পর কিছু এলাকা যখন 'রেড জোন' ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তখনও আমরা নোয়াখালীর মতো 'স্বউদ্যোগ' দেখেছি। কিন্তু নোয়াখালীতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা যেভাবে 'ক্ষমতা' দেখিয়েছেন, তা অভূতপূর্ব। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে- তাদের হাত থেকে মঙ্গলবার ব্যাংকের মতো জরুরি সেবার স্টিকার লাগানো গাড়িও রেহাই পায়নি। হেনস্তার শিকার হয়েছে সাংবাদিকসহ সাধারণ পথচারী। হামলা চালানো হয়েছে জরুরি খাদ্যপণ্যের দোকানেও। বুধবার তার আরও এক কাঠি আগ্রাসী হয়ে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সেও হামলা চালিয়েছে। এই খবরে এমন প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে, নোয়াখালীতে আইনের শাসন কি হাত গুটিয়ে নিয়েছে? লকডাউন বাস্তবায়ন এবং ক্ষেত্রবিশেষে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু তার জন্য প্রশাসন রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা প্রশাসনকে সহায়তা করতেই পারে; কিন্তু আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার তাদের কে দিয়েছে?

আমরা মনে করি, নোয়াখালীতে স্পষ্টতই লকডাউন বাস্তবায়নের বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে। একই সঙ্গে লঙ্ঘিত হয়েছে মানবাধিকার। দেশের বিভিন্ন স্থানেই ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীর দাপট নতুন নয়; কিন্তু করোনাকালেও তারা শোধরাবে না? রোগ, শোক ও কর্মহীনতায় সাধারণ মানুষ এমনিতেই এখন অসহায়। তার ওপর এমন চোটপাট তাদের পরিস্থিতি আরও নাজুকই করে তুলবে। আমরা দেখতে চাইব, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ব্যক্তিদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ও অবস্থান যা-ই হোক না কেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই এর বিকল্প নেই। একই সঙ্গে তাদের হামলা ও ভাংচুরে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে অবিলম্বে। সামাজিক হেনস্তার প্রতিকার পাওয়ার অধিকারও সংশ্নিষ্টদের রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও উচিত হবে স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছে জবাবদিহি করা। তার মদদ বা উৎসাহ ছাড়া নেতাকর্মীরা এমন মারমুখি আচরণ করতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস হয় না। তবে সবকিছুর আগে লকডাউন বাস্তবায়নের নামে কথিত 'স্বেচ্ছাসেবা' বন্ধ করতে হবে। আইন হাতে তুলে নেওয়ার এই প্রবণতা কঠোর হস্তে দমন করা না গেলে নোয়াখালীর চিত্র দেশের অন্যত্রও দেখা যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। অন্যান্য রেড জোনে যাতে এর পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে- এ ধরনের অতি উৎসাহে করোনা মোকাবিলার বদলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা ষোলোআনা।