আমাদের দেশের বাস্তবতায় বাজেট অনেক ক্ষেত্রেই কল্পনার দলিল মাত্র। উপস্থাপিত প্রস্তাবিত বাজেট ও বিদ্যমান বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা যায় এবং এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। করোনা দুর্যোগ আর বিশ্বমন্দার এই দুঃসময়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ নিয়ে দ্বিতীয়বার বাজেট পেশ করলেন। অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ-উত্তর যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এর বাস্তবায়ন বিদ্যমান বাস্তবতায় দুরূহ। অর্থাৎ আমি মনে করি, এই বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য তো নয়ই উপরন্তু এ নিয়ে নানা রকম গঠনমূলক সমালোচনার অবকাশ রয়েছে।

করোনা দুর্যোগে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল। এর বাইরে আমরাও নই। এমন বাস্তবতায় বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে বিশাল ছক অর্থমন্ত্রী কষেছেন তা বাস্তবতাবিবর্জিত বলে আমার মনে হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির, শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের গতি মন্থর, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া কার্যক্রমের প্রায় সব পথ রুদ্ধ। এমতাবস্থায় রাজস্ব অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করা অত্যন্ত কঠিন। আমাদের দেশে বাজেট দেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞসহ সংশ্নিষ্ট মহলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় কিংবা পরামর্শ নেওয়ার সব আয়োজনই মনে হয় আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব। কারণ এসবের কোনো প্রতিফলন দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় না। সরকার বা অর্থমন্ত্রী তাদের নিজস্ব ধারার বাইরে গিয়ে অন্যের মতামত কতটা আমলে নেন এ প্রশ্ন থাকে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে আমাদের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে যেসব বার্তা মিলেছে এরপরও অর্থমন্ত্রী ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ধরেছেন তা কি কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত? ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কোন জাদুবলে হবে তা আমাদের অনেকেরই বোধগম্য নয়। করোনা-ক্রান্তিতে পুরো বিষয়টিই মনে হয় উচ্চাভিলাষ ছাড়া কিছু নয়। দুর্যোগকালে এই বাজেট মোটেও আশা জাগানিয়া নয়। এই বাজেটে গতানুগতিক ধারার বাইরে বাস্তবতার প্রতিফলন কী ঘটেছে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। বিশ্বব্যাংক ২০২০-২১ অর্থবছরে যে ১ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে তা হয়তো আরও কিছু বেশি হবে; কিন্তু অর্থমন্ত্রীর প্রত্যাশা থেকে তা অনেক দূরেই থেকে যাবে।

এবার শুধু আমাদেরই নয়, সারাবিশ্বের কাছেই জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রস্তাবিত বাজেট ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে অর্থমন্ত্রী স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন। ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা কী? আমাদের স্বাস্থ্য খাতের বহুবিধ দুর্নীতির চিত্র নতুন নয়। এর স্তরে স্তরে রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা। স্বাস্থ্য খাতে খুব দরকার কাঠামোগত ব্যাপক পরিবর্তন। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় এর বিন্দুমাত্র ইঙ্গিতও নেই। রোগাক্রান্ত স্বাস্থ্য খাত নিয়ে মৌনতা হতাশাজনক।

এবার প্রস্তাবিত এই বাজেটের পর বলতে পারি, কালো টাকার বড়ই সুসময় এলো। কালো টাকা সাদা করার বিভিন্ন পথ বাতলে দেওয়া হলো। কালো টাকা সাদা করার বিষয়টির বিরোধিতা আমরা বরাবরই করে এসেছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এবারের বাজেটে এই পথ আরও সুগম করে দেওয়া হলো। বাজেটে অবাধে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ মেনে নেওয়া কষ্টকর। দুর্নীতি নির্মূলে সরকারের 'শূন্য সহিষ্ণুতা'র অঙ্গীকারের কথা আমরা অহরহ শুনি। কালো টাকার উৎস আছে অনেক। যারা প্রকৃত করদাতা তাদের কাছে বিষয়টি ভালো ঠেকার কথা নয়। অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করহারের বাইরে বাড়তি কোনো জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট অ্যাকশন প্ল্যান নেই। এই মুহূর্তে মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আমরা আতঙ্কের মধ্যে বাস করছি। সময়টা অত্যন্ত বৈরী। চারদিকে নানারকম অনিশ্চয়তা। বিদ্যমান এই পরিস্থিতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে বলা মুশকিল। অর্থনীতি স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে কতদিন লাগবে তাও অনিশ্চিত। এমতাবস্থায় বড় আয়-বড় ব্যয়ের বিশাল বাজেটের যে প্রস্তাব উপস্থাপিত হলো এর বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন এবং সংশয় থেকেই যায়। একদিকে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি অন্যদিকে অর্থনৈতিক ঝুঁকি। এ অবস্থায় বিলাসী ভাবনার অবকাশটা কোথায়? প্রয়োজনীয় অনেক খাতেই সংস্কারের প্রসঙ্গ একেবারে অনুপস্থিত। করপোরেট কর হ্রাস, স্থানীয় শিল্পকে ছাড়, ব্যক্তিশ্রেণির আয়করে ছাড় ইত্যাদি বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় কেউ কেউ হয়তো প্রশংসাও করবেন।


সবচেয়ে বড় কথা হলো, যদি দুর্নীতির বিষবৃক্ষ সমূলে উৎপাটন করা না যায় তবে অনেক ক্ষেত্রেই জনস্বার্থ-সংশ্নিষ্ট বিষয়গুলো অনর্জিত থাকবে। করোনা দুর্যোগকালেও বহু ক্ষেত্রেই দুর্নীতি-অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতার উৎকট চিত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। এটি বড়ই হতাশা ও উদ্বেগের। ব্যাংক খাত এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মে জর্জরিত। পুরো খাতটির অবস্থা ভঙ্গুর প্রায়। প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

অনিয়ম-দুর্নীতিক্রান্ত রুগ্‌ণ ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার এই প্রস্তাব পরিকল্পনা 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'- কারও কারও মতো আমিও তাই মনে করি। তারপরও খেলাপি ঋণের কারণে এ খাতের অবস্থা আরও খারাপ। তার ওপর রয়েছে করোনার আঘাত। প্রবাসী আয়েও ব্যাপক ধাক্কা লেগেছে। এর মধ্যে করোনায় ঘোষিত প্রণোদনার বেশির ভাগ অর্থ যাবে ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংক খাত সংস্কারের কোনো ইঙ্গিত মিলল না বাজেট বক্তৃতায়। যদি এ খাতের বিদ্যমান সংকট দ্রুত কাটানো না যায় তাহলে এর আরও বহুমুখী বিরূপ প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে এবং সমাজেও।

করোনা দুর্যোগের অপচ্ছায়া পড়েছে প্রায় সব খাতেই। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। একই সঙ্গে রপ্তানি আয় চিত্রও নেতিবাচক। অর্থনীতির সব অনুষঙ্গ বলতে গেলে যেখানে বিপদাপন্ন, সেখানে বাজেটকেন্দ্রিক সামষ্টিক অর্থনীতির যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে তা বাস্তবানুগ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা বলা যায় অতিরঞ্জিত। তাছাড়া ব্যাংক থেকে সরকারই যদি এত বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়ে নেয় তাহলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা ঋণ পাবেন কী করে? কাজেই সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্নেষণে একথা বলা যায়, এলোমেলো ভাবনার অগোছালো প্রতিফলনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বাজেটে।

আরও বলি, বহু ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত লক্ষ্য অবাস্তব। মানবসম্পদ খাত নিয়ে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আলোচনা বাজেট বক্তৃতায় লক্ষ্য করা যায়নি। পিছিয়ে পড়া মানবসম্পদ নিয়ে সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা কিংবা কীভাবে তা পুনরুদ্ধার করা যায় এ বিষয়ে অধিক মনোযোগ দেওয়া ছিল সময়ের অন্যতম দাবি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিংবা ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের যেসব কথা বলা হয়েছে তা কী করে সম্ভব মানবসম্পদ খাতের উন্নয়নের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে! তাই আমি বলি, এই বাজেট হলো জটিল বাস্তবতায় কল্পনার বিস্তৃত জাল।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সভাপতি সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন