গত এক দশক ধরে বাজেটের আকার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির যে প্রবণতা আমরা দেখে এসেছি, করোনা পরিস্থিতিতেও তা অব্যাহত থাকতে দেখলাম। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আমাদের মনে আছে, গত বছর জুন মাসে তিনি যখন অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বাজেট পেশ করেন, তখন উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেখে কেউ কেউ সেটাকে 'উচ্চাভিলাষী' আখ্যা দিয়েছিল। এবার করোনা পরিস্থিতিতেও প্রবৃদ্ধির একই লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চয়ই সরকারের সদিচ্ছা ও সাহসেরই প্রমাণ। আমরা দেখছি, রাজস্ব আদায়েও রাখা হয়েছে উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা। অনেকেই যে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সন্দেহ প্রকাশ করছেন, তা উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। বিশেষত করোনা পরিস্থিতিতে যেখানে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক অর্থকরী প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিকভাবেই প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করছে, সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কতটা 'সময়োচিত' ভেবে দেখতে বলি আমরা। প্রবৃদ্ধির এই লক্ষ্যমাত্রা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুুল বার্তা দিতে পারে- শুক্রবার বাজেটের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সিপিডির এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমরাও একমত। বস্তুত গত বছর প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা বাজেট প্রণয়নকালে নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এর একটি কারণ হতে পারে অর্থবছরের শেষাংশজুড়ে করোনা অস্থিরতা। সেক্ষেত্রে আসন্ন অর্থবছরের শুরু থেকেই একই বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি অনিশ্চয়তা নিয়ে প্রবৃদ্ধি বা কর আদায়ের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তি কী? যদিও বাজেট পেশের পরদিন শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবারও জোর দিয়ে বলেছেন, এই বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য। বৃক্ষের পরিচয় আমরা ফলের মাধ্যমে দেখতে চাই।
অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে, করোনায় ঝুঁকিতে পড়া মানুষকে বাঁচানোর জন্য এই বাজেট। আমরাও বাজেটের এমন অভিমুখ প্রত্যাশা করি। এবারের বাজেট যে পরিস্থিতিতে প্রণয়ন ও ঘোষণা করতে হয়েছে, স্বাধীনতার পর তেমন পরিস্থিতি কখনও হয়নি। যেমন বৈশ্বিক, তেমনই অভ্যন্তরীণ প্রায় সব খাতের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির। এই বাজেট যেখানে উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করবে বলেই প্রত্যাশা। আমরা দেখেছি, বাজেটেও সবাইকে তুষ্ট করার প্রবণতা স্পষ্ট। আয়কর সীমা বাড়িয়ে দেওয়া, কালো টাকা সাদা করার পরিসর বৃদ্ধি, নতুন কর আরোপ না করা- এসবের মধ্য দিয়ে সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতা ও বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও নিম্নবিত্তদের জন্য ইতিবাচক বার্তা দেয়। কৃষিতে ভর্তুকি বর্তমান সরকার টানা তিন মেয়াদের প্রথম থেকেই দিয়ে আসছে। করোনা পরিস্থিতিতে তাতে আরও জোর দেওয়া সঙ্গত হয়েছে। আমরা দেখেছি, করোনা মোকাবিলায় বাজেট ঘোষণার আগেই প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন খাতের জন্য ঘোষণা করেছিলেন তাৎক্ষণিক প্রণোদনা প্যাকেজ। এর ছাপ আমরা দেখতে পাচ্ছি বাজেটেও। কিন্তু অস্বীকারের অবাকশ নেই যে, স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আমরা আরও বেশি বরাদ্দ ও স্পষ্টতর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দেখতে চেয়েছিলাম। ঘোষিত বাজেটে এ ব্যাপারে আন্তরিকতার ছাপ থাকলেও মুনশিয়ানার অভাব স্পষ্ট। আমরা প্রত্যাশা করি, আগামী কয়েক দিনের বাজেট আলোচনায় এ ব্যাপারে আরও স্পষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হবে।
আমরা দেখতে চাইব, বাজেট, বরাদ্দ, লক্ষ্যমাত্রা যাই হোক- সুশাসনে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সূচক সত্ত্বেও অতীত অর্থনৈতিক সুশাসন নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। করোনা পরিস্থিতিতেও যদি তা অব্যাহত থাকে, তার জের হবে দ্বিগুণ। আমরা মনে করি, বর্তমান বাজেট যদি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, প্রবৃদ্ধি বা রাজস্বেও লক্ষ্যমাত্রায় খানিকটা ছাড় দিয়েও সুষ্ঠুভাবে করোনাকাল পারি দেওয়া সম্ভব। এও মনে রাখতে হবে, করোনা পরিস্থিতিতে বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়নের গতানুগতিক ধারায় অবস্থানেরও অবকাশ নেই। এই বাজেট ঘোষণার আগেই অর্থনীতিবিদদের মধ্য থেকে দাবি উঠেছিল, এক বছরের বদলে ছয় মাসের বাজেট ঘোষণা করা হোক। তা সম্ভব না হলেও বাজেট বাস্তবায়নে এমন মনোভাব থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ আমরা জানি না, কয়েক মাস পরে বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে। পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে সরকারের যে প্রত্যয় বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে, আমরা সেটাকে খাটো করতে চাই না। কিন্তু ভুলে যাওয়া চলবে না, পরিস্থিতি বুঝে বাস্তবোচিত ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট প্রণয়ন ও ঘোষণাই সর্বোত্তম।
মন্তব্য করুন