আধুনিক রাষ্ট্রে থাকে চিন্তক-বর্গ। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ 'থিঙ্কট্যাঙ্ক'। তাদের মূল কাজ হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ে গভীর চিন্তা ও গবেষণা করা এবং তাদের আলোচনা, পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ জনপরিসরে তুলে ধরা। উন্নত বিশ্বে আমরা দেখি, সরকারপ্রধানসহ রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা এসব চিন্তক-বর্গের আলোচনা, পর্যবেক্ষণ বা সুপারিশ সম্পর্কে আগ্রহী থাকে বা গ্রহণ করে। তাদের নীতি ও কর্মসূচিতে প্রতিফলন ঘটায়। কখনও কখনও তাদের ডেকে সরাসরি পরামর্শ গ্রহণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে ভাষাবিষয়ক চিন্তক-বর্গের মধ্যেই চিন্তায় বৈপরীত্য প্রায়ই চোখে পড়ে। এই বৈপরীত্যের অন্যতম হলো ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে বৈপরীত্য।

সাধারণভাবে আমরা জানি যে, ভাষা একটি সংজ্ঞাপনের মাধ্যম। কিন্তু ভাষা শুধু একটি সংজ্ঞাপনের মাধ্যম নয়। সাধারণ মানুষ ভাষাকে একটি সংজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে বুঝলে কোনো সমস্যা নেই। সাধারণ মানুষের এত কিছু বোঝার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু একটি দেশের চিন্তক-বর্গ যখন ভাষা কী- তা যদি ভালো করে না বোঝেন, তাহলে সেই দেশে ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে কোনো যৌক্তিক ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন। বিষয়টির গভীরে যাওয়ার আগে ভাষা যে কী তা নিয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে।

ভাষা প্রেক্ষাপটভেদে নানা রকম প্রভাবক হিসেবে অবতীর্ণ হয়। এটি একদিকে জাতীয়তাবাদীদের কাছে যেমন জাতীয়তাবাদ ও সভ্যতার প্রতীক, আবার অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে এটি হলো সাম্রাজ্যবাদের অস্ত্র বিশেষ, যার মাধ্যমে অনুবর্তী দেশের সমাজ-সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করা যায়। সে বিবেচনায় ইংরেজি ভাষা হলো- আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার হাতিয়ার বিশেষ, আর বাংলা ভাষা হলো দেশের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষারবূ্যহ বিশেষ।

আমাদের দেশের কিছু মানুষের কাছে ইংরেজি ভাষা কোনো সংস্কৃতির বিষয় নয় বরং তাদের কাছে এটি হলো- ক. উচ্চশিক্ষার একটি মাধ্যম, খ. আভিজাত্যের প্রতীক, গ. জ্ঞান-গর্বের প্রতীক, ঘ. পাশ্চাত্যে অভিবাসনের সুযোগ ও ঙ. সামাজিক গতিশীলতার সিঁড়ি বিশেষ। কিন্তু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো- ক. বৃহত্তর জাতীয় সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম, খ. সামাজিকীকরণের মাধ্যম, গ. জাতীয়তাবাদের প্রতীক, ঘ. সভ্যতার বাহন, ঙ. সামাজিক সম্পদ ও চ. সাংস্কৃতিক সম্পদের নিয়ামক। অপরপক্ষে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো- ক. ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার, খ. অন্যের সংস্কৃতিকে কলুষিত করার হাতিয়ার, গ. অন্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে পরাধীন করার হাতিয়ার বিশেষ।

ভাষার উক্ত বহুরূপ উপযোগিতা সম্পর্কে বাংলাদেশে রাষ্ট্রের চিন্তক-বর্গ ওয়াকিবহাল রয়েছেন বলে মনে হয় না। কেননা, চিন্তক-বর্গ দেশের নানান নীতি, যেমন- পাটনীতি, অর্থনীতি, পানিনীতি ও শিক্ষানীতি ইত্যাদি নিয়ে সরব থাকলেও ভাষানীতি নিয়ে নীরব রয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে এই ভাষানীতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে চিন্তক-বর্গের মধ্যে কোনোরূপ আফসোস বা উপলব্ধিও নেই। ভাষানীতি সম্পর্কে তাদের এই নির্লিপ্ততার কারণ হলো- ক. ভাষিক ইতিহাস ও ভাষা পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞতা, খ. পাশ্চাত্যায়নের প্রতি লোলুপতা ও গ. ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব।

যদিও রাষ্ট্রের চিন্তক-বর্গের নজরে আসছে না, কিন্তু দেশে একটি বিপজ্জনক ভাষা পরিস্থিতি বিরাজিত রয়েছে এবং এই ভাষা পরিস্থিতি দিনের পর দিন বদলাচ্ছে। আর এই বিপজ্জনক ভাষা পরিস্থিতির সুযোগে দেশের ভাষা-সাংস্কৃতিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, যার ভবিষ্যৎ পরিণতি হতে পারে জাতীয় অসংহতি।

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার কেন্দ্রস্থল। এখানেই অবস্থান করেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু রাজধানী ঘিরেই বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে ধ্বংসের ইংরেজি নামক বিষক্রিয়ার পরিব্যপন শুরু হয়েছে। এই বিষক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায়, যা প্রতিভাত হচ্ছে, তা হলো- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সর্বত্র ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে, খ. বেসরকারি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত হচ্ছে, গ. অধিকাংশ মানুষ লেখ্যভাষা হিসেবে ইংরেজি ও বাচ্যভাষা হিসেবে বাংলা-ইংরেজি মিশেল ভাষা ব্যবহার করছে।

উক্ত ভয়াবহ ভাষা-সমস্যা সম্পর্কে চিন্তক-বর্গ ওয়াকিবহাল নয়। যদি তারা ওয়াকিবহাল থাকতেন তাহলে তারা দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরামর্শ জোগাতেন। বরং দেখা গেছে, বাংলাদেশের পক্ষে বাংলাভাষাকে জাতিসংঘের ভাষা হিসেবে চালুর ব্যাপারে দাবি জানানো হচ্ছে। এই ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা বিবেচনায় তেমন দাবি জানাতেই পারে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা থেকেও একই দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু তার আগে বাংলাভাষীরা যাতে ভাষাটি ঠিকভাবে ব্যবহার করে তা নিশ্চিত করতে হবে না? একদিকে বাংলা ভাষার ব্যবহার কমে যাচ্ছে অন্যদিকে ইংরেজিসহ বিদেশি নানা ভাষায় দেশের ভাষা-সংস্কৃতি কলুষিত হচ্ছে।

ভাষা-সংস্কৃতির এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে দেশে একটি যুগোপযোগী ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এই ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নে প্রয়োজন একটি ভাষানীতির, যেখানে দেশের ভাষা সমস্যার সমাধান ও জাতি গঠনের এ প্রয়োজনে বিভিন্ন ভাষাকে তার গঠন, মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা অনুসারে আনুপাতিক হারে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এই ভাষানীতিতে শিক্ষা ব্যবস্থায় নিচের ভাষাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ক. দেশের ভাষা-সংস্কৃতিকে সুরক্ষার প্রয়োজনে জাতীয়তাবাদের প্রতীক, জাতীয় সংস্কৃতির বাহক ও সামাজিকীকরণ ও বৃহত্তর সমাজে আত্তীকরণের নিয়ামক জাতীয় ভাষাকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থায় চালুকরণ। খ. জাতীয় ইতিহাসের শিকড় সন্ধানে আরবি, ফার্সি, পালি ও সংস্কৃত ইত্যাদি ধ্রুপদী ভাষাকে শিক্ষা ব্যবস্থার অঙ্গীভূতকরণ, গ. বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সুবিধা থেকে জাতিকে সমৃদ্ধ করতে বিভিন্ন বিদেশি ভাষাকে আনুপাতিকহারে গুরুত্ব দিয়ে সব বিদেশি ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থায় এমনভাবে অঙ্গীভূতকরণ যেন চীনা, জাপানি, ফরাসি, জার্মান, স্পেনীয় ইত্যাদি ভাষাগুলো ইংরেজির সমান গুরুত্ব পায়। এই ব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষাকেন্দ্রিক বিদেশি ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থার নাগপাশ থেকে মুক্তি ঘটবে। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশের ভাষা-সাংস্কৃতিক সংকট থেকে মুক্তি ঘটবে। আর চিন্তক-বর্গের বৈপরীত্যময় চিন্তা থেকে দেশের ভাষা-সাংস্কৃতিক সংকটের মহামুক্তি ঘটবে।

অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
razaul_faquire@du.ac.bd