কামাল লোহানীর এই সাক্ষাৎকার সমকালের সম্পাদকীয় ও মন্তব্য পাতায় প্রকাশ হয়েছিল ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি; তার ৮৪তম জন্মদিন উপলক্ষে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন সমকালের সহকারী সম্পাদক শেখ রোকন। কামাল লোহানীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাক্ষাৎকারটির সংক্ষেপিত ভাষ্য আমরা পুনঃপ্রকাশ করছি

সমকাল : আমরা জানি, পঞ্চাশের দশক থেকেই আপনি একাধারে রাজনীতি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও সাংবাদিকতা করেছেন। প্রথমেই জানতে চাই, রাজনীতিতে কীভাবে জড়িত হয়েছিলেন?

কামাল লোহানী : আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়তাম পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। থাকতাম ছোট চাচার বাসায়। তিনি জিলা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মূলত এই সময়েই কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসি এবং সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত হই। পাবনায় ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে যেসব তরুণ প্রথম সারিতে ছিল, আমি তাদের মধ্যে ছিলাম। রাজনীতির কারণেই জেলে যেতে হয়েছিল তখন। জেলের মধ্যে বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতাদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাই।

সমকাল : কতবার জেলে গিয়েছিলেন?

কামাল লোহানী : চারবার। প্রথমবার ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। দ্বিতীয়বার ১৯৫৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান সেরে পাবনা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ইছামতী নদী হাঁটুপানিতে পার হয়ে চাচার বাসায় ফিরছিলাম। সেখান থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তৃতীয়বার জেলে যাই ওই বছরেরই ২৯ মে। যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়ে গভর্নরস রুল জারি হয় এবং বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়। আমি গ্রেপ্তার হই সিরাজগঞ্জে গ্রামের বাড়ি থেকে। আমার মনে আছে, পরদিন ছিল ঈদ। উলল্গাপাড়া থানায় বসে ঈদের চাঁদ দেখেছিলাম। যখন লোকজন ঈদের নামাজ পড়তে যাচ্ছিল, তখন আমাদের নেওয়া হচ্ছিল পাবনা জেলে। আগের তুলনায় সেবার কারাবাস দীর্ঘ ছিল। পরের বছর আগস্টে ছাড়া পাই। আর চতুর্থবার গ্রেপ্তার হই ঢাকায়; ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের কারণে।

সমকাল : পাবনায় আপনাকে প্রথমবার আটকের অভিযোগ কী ছিল- ভাষা আন্দোলন?

কামাল লোহানী : হ্যাঁ, প্রথমবার ভাষা আন্দোলনের কারণে। দ্বিতীয়বারেরটিও ভাষা আন্দোলনের কারণে; কিন্তু বিষয়টি ছিল ইন্টারেস্টিং। পাবনায় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের সভা ছিল। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কনফারেন্স। তার আগের বছর ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে তিনি 'খুনি নূরুল আমীন' হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছিলেন। আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, 'নূরুল আমীনের সভা হতে দেব না।'

সমকাল : অনেক সংবাদপত্রে কাজ করেছেন আপনি। এখন সেগুলোর নাম বলতে পারবেন?

কামাল লোহানী : অনেক পত্রিকা; সব নাম ঠিক মনেও নেই। তারপরও চেষ্টা করে দেখি। মিলল্গাত থেকে অর্ধসাপ্তাহিক পাকিস্তান। তারপর সংবাদ, সেখান থেকে দৈনিক আজাদ। আজাদ থেকেই সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের কারণে আটক হই। জেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ বিশিষ্ট নেতাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। জেল থেকে বের হয়ে পয়গাম পত্রিকায় যোগ দিই। তারপর পূর্বদেশে কাজ করার সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। ভারতে গিয়ে যোগ দিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। মুক্ত স্বদেশে এসে প্রথমে কিছুদিন বাংলাদেশ বেতারে, তারপর দৈনিক জনপদে। জাতীয় চার নেতার একজন কামরুজ্জামান ছিলেন এর প্রকাশক। সেখান থেকে মওলানা ভাসানীর অনুসারী গোলাম কিবরিয়ার দৈনিক বঙ্গবার্তা। নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে সেখানে বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলাম। কিন্তু সাড়ে তিন মাসের মাথায় পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এর পর বাংলার বাণী। ১৯৭৫ সালে পত্রিকাটি বিলুপ্ত করা হলে আমাকে রাজশাহীতে পাঠানো হয় দৈনিক বার্তার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে। কিছুদিন পর সম্পাদকের দায়িত্ব নিই। এই সময় আমার মন খারাপ হলো। পেশাগত জীবনে ইউনিয়নের নেতা ছিলাম। সম্পাদকরা ছিল এক ধরনের প্রতিপক্ষ। তাদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে হতো। কিন্তু আমি নিজেই সম্পাদক হয়ে গেলাম!

সমকাল : আপনি তো সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। ছায়ানট, ক্রান্তি, গণশিল্পী সংস্থা; সর্বশেষ উদীচীতেও ছিলেন। রাজনীতি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও সাংবাদিকতার মধ্যে কোনটা আপনার পছন্দের ছিল?

কামাল লোহানী : পেশাগতভাবে আমি সাংবাদিক ছিলাম। কিন্তু নেশাগতভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম। আমি জানতাম ও দেখেছি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন কীভাবে দেশের ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি, গণসংগীত মানুষকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করত। তবে আমার জীবনের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ। একজন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক পরিচয়কেই সবচেয়ে বড় মনে করি। আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বার্তাপ্রধান ছিলাম শুরু থেকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মে এর অনুষ্ঠান আমরা শুরু করেছিলাম নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা দিয়ে। আর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের খবর আমি নিজে লেখা, সম্পাদনা ও বেতারে পাঠ করেছিলাম।

সমকাল : আপনি পাকিস্তান আমলে ও মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকার কথা বললেন। এখন সাংস্কৃতিক আন্দোলন সেই ভূমিকা রাখতে পারছে না কেন?

কামাল লোহানী : এর কারণ রাজনৈতিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে একটা সর্বনাশা বিভাজন ঘটে গেছে। আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সাংস্কৃতিক শাখা খুবই শক্তিশালী ছিল। এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি গোপনে বিভিন্ন নামে তাদের প্রকাশ্য সাংস্কৃতিক শাখা সংগঠিত করত। আমাদের ক্রান্তি ছিল তাই। আবার সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনা ছিল স্পষ্ট। ছায়ানট গঠিত হয়েছিল একটি রাজনৈতিক চেতনা সামনে রেখে। এখন সেটা আর নেই। ফলে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর ভূমিকা রাখতে পারছে না। সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোয় সাংস্কৃতিক ভূমিকা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রাজনৈতিক চেতনা ফিরিয়ে আনতেই হবে।