লোহানী ভাই শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন। অনেক দিন ধরেই তিনি কিডনি, লাং ও হূৎপিণ্ডের সমস্যায় ভুগছিলেন। ডায়াবেটিসও জুটেছিল তার সঙ্গে। কিন্তু তার সবচেয়ে বিড়ম্বনার কারণ হয়েছিল- যেসব দিয়ে তিনি পড়তেন ও লিখতেন, সেটাই কার্যত চলে যাওয়ায় সে কাজে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হতো। তার পরও তিনি লেখা ছাড়েননি। মাঝে মাঝেই তার ক্ষুরধার কলাম বেরোত। পত্রিকায় তার আত্মজীবনী লেখার কাজও চলছিল একই সঙ্গে।

এই করোনাকালে লোহানী ভাইয়ের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতে গিয়ে জেনেছিলাম- মহামারির মধ্যেও আত্মজীবনী লেখার কাজ এগোচ্ছে। শেষ করে যেতে পারলেন কিনা জানি না। তবে আমি দেখতে চাইব- যতখানিই লেখা হয়েছে, তা যেন প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সংবাদপত্রে লোহানী ভাই যেসব লেখা লিখেছেন, সেগুলোও সংকলন হিসেবে প্রকাশ হতে পারে। আমি নিশ্চিত, এসব উদ্যোগ আগামী দিনগুলোতে নেওয়া হবে এবং লোহানী ভাইয়ের জীবন ও কর্ম ভাবী প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলবে।

অবশ্য লোহানী ভাইয়ের জীবন ও আদর্শ বোঝার জন্য আত্মজীবনী বা অন্য কোনো গ্রন্থের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, এমন নয়। তিনি যেমন সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে ভেবেছেন, কথা বলেছেন, তেমনই লেখালেখিতেও ক্ষান্ত দেননি। তিনি যেমন আমাদের ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী, তার লেখালেখিগুলোও তেমনি মূল্যবান দলিল।

তার অসংখ্য লেখার মধ্যে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আইয়ুববিরোধী সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ-পরবর্তী পুনর্গঠন প্রক্রিয়া, এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বিএনপি-জামায়াতবিরোধী আন্দোলন ও বর্তমান শাসনের অপূর্ণতা, ব্যর্থতা, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ- এসব বিষয়ে তিনি কেবল কলমই ধরেননি, মাঠের আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সম্পর্কে তার লেখা আন্দোলনের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বয়সও তাকে এসব ক্ষেত্রে মাঠের আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে পারেনি।

কামাল লোহানী সাধারণভাবে পরিচিত সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও। পেশার কারণে সাংবাদিকতা জীবন বেছে নিলেও পঞ্চাশ ও ষাট, সত্তর দশকই নয়, বাংলাদেশ উত্তরকালেও রাজনৈতিক ভাবনায় সক্রিয় ছিলেন।

রাজনীতির দুর্গম পথে তার যাত্রা শুরু ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তখন তিনি স্কুলের শেষ পর্বে, কলেজে উঠেছেন। এ সময় তিনি সংযুক্ত হন তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টি- পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৫৩ সালে প্রথম গ্রেপ্তার হন পাবনায় মুসলিম লীগের কাউন্সিলে নুরুল আমিনের যোগদানের বিরোধিতা করতে গিয়ে। এরপর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টে কাজ করতে গিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। জেল থেকে বেরিয়ে ঢাকায় এসে তিনি সাংবাদিকতায় যোগদানের পাশাপাশি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠিত হলে তিনি তাতে যোগ দেন।

লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বাষট্টির সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে জেলখানায়। আমরা পুরোনো হাজতে আর তিনি ছাব্বিশ সেলে। শুনেছি সে সময় তিনি জেলখানা মাতিয়ে রাখতেন তার প্রাণোচ্ছল ব্যবহার দিয়ে। পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে লোহানী ভাই তার জেলজীবনের কথা বলেছেন ও লিখেছেন। বিশেষত পাবনায় ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে কীভাবে স্থানীয় মুসলিম লীগের রোষানলে পড়েছিলেন, সেই ঘটনা গল্প হিসেবেও খুবই চিত্তাকর্ষক। এখনকার প্রজন্ম হয়তো বিশ্বাসই করতে পারবে না আদর্শের জন্য লোহানী ভাই বা আমরা কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছিলাম।

এরপর থেকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, সাংবাদপত্রের স্বাধীনতার আন্দোলন, রবীন্দ্র শতবাষির্কী, ছায়ানট প্রতিষ্ঠা, কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্তি, ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির বুদ্ধিজীবী সেলের পরিচালক ও বাংলাদেশ উত্তরকালে 'সাপ্তাহিক নয়া যুগ ও দৈনিক বঙ্গবার্তা, গণশিল্পী সংস্থার প্রতিষ্ঠা, বাকশাল বিরোধিতা, এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও বিএনপি-জামায়াতবিরোধী আন্দোলনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও সর্বোপরি আমাদের পার্টির মুখপত্র 'নতুন কথা'র উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে এত বছর ধরে তার সঙ্গে একত্রে পথ চলেছি। বলা যায় ছাত্রাবস্থায় ও আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় তো বটেই বাংলাদেশ পরবর্তীকালেও তার বাসা ছিল আমাদের আশ্রয়স্থল।

লোহানী ভাইয়ের কথা বলতে গেলে দীপ্তি বউদির কথা বলতে হয়। বলতে হয় তার শাশুড়ি মাসিমার কথা। তারা যেমন লোহানী ভাইয়ের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবন সামলেছেন, আমাদের অত্যাচারও সহ্য করেছেন। লোহানী ভাই নিজেও দীপ্তি বউদিকে আখ্যা দিতেন লড়াইয়ের সহযোদ্ধা হিসেবে। আমার মনে আছে, গত বছর দীপ্তি বউদির মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে নিয়ে দৈনিক সমকালে লিখেছিলেন এই শিরোনামেই।

লোহানী ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত গণশিল্পী সংস্থা নিয়ে অতৃপ্তি তাকে উদীচীর কাছে টেনে নেয়। উদীচী তাকে সভাপতির পদ দিয়ে বিশেষ সম্মানিত করেছিল। শোনা যায় এ সময় সিপিবি তাকে সদস্যপদ দেয়। কিন্তু এ নিয়ে কখনও তিনি আমাকে বা আমাদের কাউকে কিছু বলেননি। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কোনো শিথিলতা হয়নি। এ সময়কালেও তিনি 'নতুন কথা'র জন্য লিখতেন। প্রয়োজনে যে কোনো পরামর্শ ও সাহায্য দিতেন।

লোহানী ভাইর শেষ দিককার অতৃপ্তি ছিল- দেশে ক্রমপ্রসারমান সাম্প্রদায়িকতা, তার রাষ্ট্রীয় পোষকতা। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অনমনীয়। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে করপোরেটগুলোর আধিপত্য, আকাশ সংস্কৃতির বিকৃতি তাকে ভীষণভাবে বিচলিত করত। দেশের মানুষের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে যাওয়া, দুর্নীতি আর অপরাজনীতি তাকে বেদনার্ত করেছে। আর এসব নিয়ে লিখতেনই শুধু না, মাঠের সমাবেশ আলোচনায়ও তার অসুস্থ শরীর নিয়ে উপস্থিত হতেন।

করোনা নিয়ে লোহানী ভাইয়ের মৃত্যু ঘটায় যেভাবে তাকে বিদায় দেওয়ার কথা ছিল, সেটি হলো না। এমনকি স্বাস্থ্যবিধির কারণে মেডিকেল কলেজে তার দেহদানের ইচ্ছাও অপূর্ণ রইল। তিনি সমাহিত হতে তার জন্মস্থানে চলে গেলেন। লোহানী ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন কেবল আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার নয়। দূর থেকেও সারা জাতি তাকে শ্রদ্ধা জানাবে। আমরা তাকে আজীবন মনে রাখব। লোহানী ভাইয়ের জীবন, আদর্শ ও সংগ্রাম তাকে জীবন্ত রাখবে যুগ যুগান্তর।

কামাল লোহানী কেবল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বই ছিলেন, ছিলেন না কেবল সাংবাদিক, ছিলেন এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের লড়াকু যোদ্ধা। তার বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার পরও তার এই লড়াকু চরিত্রই তাকে বারবার জীবনে ফিরিয়ে এনেছে। তবে করোনা তাকে ছাড়ল না। এ জাতি করোনাযুদ্ধে জয়ী হয়ে তার জন্য ধরে রাখা সব শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকে গভীরতর করবে। লোহানী ভাই লাল সালাম।

রাজনীতিক, সংসদ সদস্য, সভাপতি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি