- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিমুক্ত হোক
চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ নিয়োগ
সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিমুক্ত হোক
চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ নিয়োগে যে তুঘলকি কাণ্ড চলছে সে ব্যাপারে আমরা এ সম্পাদকীয় স্তম্ভে বারবার সতর্ক করার পরও তার কোনো প্রতিকার হয়নি। বস্তুত একটি সিন্ডিকেটের সক্রিয়তার কারণে চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ নিয়োগে দুর্নীতি প্রবেশ করেছে। এ সিন্ডিকেট কতটা বেপরোয়া ও শক্তিশালী তা বোঝার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, অনিয়ম-দুর্নীতির ভয়াবহ অভিযোগ ওঠার পরও ১৮৩ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া ত্রুটিমুক্ত হয়নি। বরং শনিবারের সমকালে এসেছে, সিন্ডিকেটটি নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করতে তৎপরতা চালাচ্ছে। এমনকি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত লঙ্ঘন করে ৬২ জনকে নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে।
আমরা জানি, একটি সিন্ডিকেট বিভিন্ন ফার্মের নামে করোনার সব ধরনের কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ করছে, যেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একাংশও জড়িত রয়েছে। যারা বিভিন্ন হাসপাতালে এন-৯৫ মাস্ক লেখা মোড়কে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক সরবরাহ করাসহ করোনাভাইরাস পরীক্ষার রক্ত সংগ্রহের টিউব, সিরিঞ্জ থেকে শুরু করে পিসিআর মেশিন কেনাসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রীর ক্ষেত্রেও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ। করোনা সম্পর্কিত কেনাকাটার এই সিন্ডিকেটই চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত বলে যে অভিযোগ রয়েছে তাতে বিস্মিত হওয়ার সুযোগ সামান্যই। শর্ত লঙ্ঘন করে ১৮৩ জনের মধ্যে ৬২ জনকে নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে ওই সিন্ডিকেটটি জনপ্রতি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা করে নেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তা গুরুতর। এর মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে এতদিন নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার কাজে যুক্ত থাকা চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদদেরও যে বঞ্চিত করা হচ্ছে তা স্পষ্ট।
যদিও এ নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনার বিষয়টিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। তাদের যুক্তি, রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন বলে এরা কোনো ফর্মুলায় পড়বে না। পরবর্তীকালে যাদের নিয়োগ দেওয়া হবে তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথ শর্ত প্রযোজ্য হবে। কিন্তু আমরা দেখছি, সেখানেও ঘাপলা রয়েছে। আমরা জানি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেমন স্বেচ্ছাসেবী অর্থাৎ বিনা বেতনে করোনার সময় কাজ করেছেন- এমন চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদদের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতিও তাদের ফাইলে প্রমার্জনা দিয়েছেন। কিন্তু যাদের জন্য এই নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, তাদের বাদ দিয়ে মে মাসের শেষ দিকে কিংবা জুনের প্রথম সপ্তাহে ব্র্যাক, আইদেশী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এসে করোনার কাজ শুরু করেছে, এমন চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদদের নিয়োগের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অথচ এসব ব্যক্তির অধিকাংশই স্বেচ্ছাসেবী নন বরং তারা প্রত্যেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বেতনভুক কর্মচারী।
আমরা দেখছি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পদস্থরাই এ নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছেন তারপরও চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ নিয়োগে যেভাবে দুর্নীতি হচ্ছে, যেভাবে সিন্ডিকেটের কালো থাবা এখানে বিস্তৃত হচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। করোনাদুর্যোগের এ সময়ে জাতি যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, এ থেকে উত্তরণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যে দায়িত্বশীল ভূমিকা দেখার কথা ছিল তার পরিবর্তে যেভাবে এ অধিদপ্তর নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে তা দুঃখজনক। করোনার সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে কোনো চক্র যদি ফায়দা লাভ করে এবং এর মাধ্যমে অন্যদের বঞ্চিত করা হয় সেটি নিশ্চয়ই কাম্য হতে পারে না।
আমরা মনে করি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সিন্ডিকেটের ভূত তাড়াতে হবে। আর চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ নিয়োগে যেহেতু দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসেছে, এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সব অনিয়ম তদন্ত করে বের করে এর সঙ্গে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা চাই। সমকালের প্রতিবেদনে এসেছে, ১৮৩ জনের বাইরে আরও এক হাজার ১৭ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ করবে সরকার। এজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নামের তালিকা চেয়ে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এভাবে তালিকা চেয়ে নিয়োগ দিলেও দুর্নীতির শঙ্কা থেকেই যাবে। ইতোমধ্যে অভিযোগও উঠেছে, তালিকায় নাম থাকলে চাকরি নিশ্চিত মনে করে কাজ করেননি এমন ব্যক্তিরাও টাকা দিয়ে তালিকায় নাম উঠানোর চেষ্টা করছেন। এতে বরং যারা করোনায় কাজ করেছেন তাদেরও বঞ্চিত হওয়া আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। ফলে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েই নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। সিন্ডিকেট ভেঙে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
মন্তব্য করুন