কভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাস এই শতাব্দীর একটি বিশ্ব-মহামারি বা বিশ্ব-মহাদুর্যোগ, যাই বলি না কেন, বিশ্বব্যাপী এই করোনাভাইরাসের বিভীষিকাময় বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব বেড়েই যাচ্ছে। এক কথায় আমরা কঠিন সময় পার করছি। এই পরিস্থিতিতে মানবিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু শিক্ষণীয়ও আছে।
নভেল করোনার নেতিবাচক প্রভাব নিশ্চয়ই রয়েছে। আক্রান্তদের শারীরিক-মানসিক কষ্টসহ চিকিৎসাসেবার অসহায়ত্ব, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অবজ্ঞা এবং অবহেলায় পরিস্থিতি অনেকটা জটিল করেছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা অর্থাৎ বেকারত্ব সংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্য স্থগিত, প্রবাসী শ্রমিকদের বেকারত্ব বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে যারা দিনমজুর, অপ্রাতিষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র কৃষক ও খামারি, তাদের অবস্থা সবচেয়ে বিপর্যস্ত।
প্রশাসনসহ সব দপ্তরের একযোগে কাজ করার প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ায় লকডাউন বহাল বা তোলা, সাধারণ ছুটি প্রভৃতি নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কর্মহীনতা বৃদ্ধির ফলে বেকারত্ব ও ভিক্ষুকের সংখ্যা বৃদ্ধি, আবার শ্রমিক সংগঠন নেতাদের দায়িত্বহীনতা ও স্বচ্ছতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে এবং চরম অসন্তোষের চিত্র দেখা গেছে। তা ছাড়াও রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আস্থাহীনতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
নভেল করোনার প্রথম ইতিবাচক ফলাফল হচ্ছে, অনলাইন অফিস, প্রশাসন, শিক্ষা কার্যক্রম, কোর্টসহ ঘরে বসে অফিস করার মাধ্যমে অনলাইন বাংলাদেশের একধাপ অগ্রসরতা। মহামারি প্রতিরোধ, জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। হাত ধোয়ার জন্য দামি দামি পণ্যের মুখরোচক বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়েছে। চিকিৎসা খাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সৃজনশীলতা বৃদ্ধি; প্লাজমা থেরাপি দিয়ে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার পরীক্ষামূলক উদ্যোগ; সরকারি-বেসরকারি হাসপাতলের চিকিৎসা ব্যবস্থার আসল স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে, যা পরবর্তীতে মানসম্মত চিকিৎসাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সরকারকে সহায়তা করবে। খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষক ও খামারিদের উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন হয়েছে। রান্নাবান্নাসহ গৃহস্থালি কাজে পুরুষদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ফাস্টফুড গ্রহণের মাত্রা কমেছে। তা ছাড়া সাধারণ মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বায়ু ও পানিদূষণের মাত্রা কমেছে, ফলে এই সময় প্রতিটি শহরের বৃক্ষ ও গাছপালার সবুজে ভরা আসল চেহারা দেখতে পাওয়া গেছে। পরিবেশবিরোধী পর্যটন বন্ধ থাকায় কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে সাগরলতা, ডলফিন, লাল কাঁকড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির অণুজীবের অবাধ বিচরণ ঘটছে। চট্টগ্রামের হালদা নদীতে রেকর্ড পরিমাণে মাছের ডিম আহরণ হয়েছে। সর্বোপরি, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কাঠামো ও পরিকল্পনার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাজেট প্রণয়নের গতানুগতিক কাঠামোর বাইরে এসে জনবান্ধব কাঠামো প্রণয়ন ও চলমান ব্যবস্থাপনার সংস্কার আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে আর অনলাইন ব্যাংকিং সম্প্রসারণ ও মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণে কাঠামো বিষয়ের আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে।
আলোচ্য অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু সুপারিশ করা যায়। প্রথমত, মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে, সরকারি হাসপাতালের প্রয়োজনীয় স্থাপনা, সরঞ্জাম, চিকিৎসক, নার্স, অন্যান্য কর্মী, অ্যাম্বুলেন্স সংখ্যা, জরুরি চিকিৎসাসেবা কাঠামো বৃদ্ধিসহ সার্বিক অবকাঠামোর সম্প্রসারণ, সব ধরনের দুর্নীতি বন্ধ করা এবং চিকিৎসকদের দায়বদ্ধতা তৈরি করা। বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জনবান্ধব আইনি কাঠামো তৈরি করা।
দ্বিতীয়ত, টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ও সূচকসমূহ অর্জনে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনেক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলো জাতির যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় যেন গবেষণালব্ধ সহায়তা দিতে পারে, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোর সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি সব দপ্তরের বিধিবদ্ধ সম্পর্ক স্থাপন করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ল্যাবরেটরিতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ কাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি করতে বাজেটে বরাদ্দ দিতে হবে। এর ফলে শিক্ষা হবে বাস্তবমুখী আর ভবিষ্যতে শিক্ষাঙ্গনে হানাহানি কমবে এবং শিক্ষকরা অনেক বেশি শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে পারবেন। সব শিক্ষককে ডিজিটাল শিক্ষাক্রম পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করাসহ শিক্ষাবাণিজ্য রোধ করা।
তৃতীয়ত, কৃষকের কষ্টার্জিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার তৈরি ও বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে; উচ্চ ফলনশীল যেসব বীজ ও সার কৃষক পুনঃউৎপাদন করতে পারে, তার ব্যবহার বৃদ্ধি করতে কৃষি বিভাগসহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়কে খাদ্যের সংরক্ষণাগার, মজুদ বৃদ্ধিসহ খাদ্য বাজারজাতকরণে সরকারি পরিবহনের ব্যবস্থাসহ প্রত্যেকটি রেল পরিবহনের সঙ্গে আলাদা কৃষিবগি থাকতে হবে। যেখানে কৃষিপণ্যসহ কৃষক যাতায়াত করতে পারবেন। আর সামরিক বাহিনীর উদ্ভাবিত এক মিনিটের বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কৃষি ও খাদ্য কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষিত করা।
চতুর্থত, শ্রমিকের দক্ষতা, অধিকার ও প্রবাসী শ্রমজীবীদের কল্যাণে; শিল্প, শ্রম, কর্মসংস্থান এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা দরকার। যাতে দেশে শ্রমিক অসন্তোষ না থাকে এবং প্রবাসী শ্রমিকরা অনেক বেশি আয় করতে ও বিদেশে নিরাপত্তা পেতে পারেন, যা দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখবে।
পঞ্চমত, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, পানিসম্পদ, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, খাদ্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যে কোনো মানবিক বিপর্যয়ে যাতে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তার একটি আইনি কাঠামো তৈরি করতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি-২০১৯ কে পর্যালোচনা করে মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক আইন হিসাবে প্রণীত করা দরকার। সরকারের প্রতিটি দপ্তরের কার্যক্রম আইনের অধীন এবং সব আইনের বিধিমালা নিশ্চিত করা।
গবেষক; উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত