অভ্যাস কিংবা প্রয়োজনের তাগিদে সকালে ঘুম থেকে জেগে পত্রিকার পাতায় চোখ রাখতে গিয়ে অনেক অজানা শঙ্কার ধাক্কা খাই। দুরুদুরু বুকে চোখ রাখি টেলিভিশনের পর্দায়। বিষাদে মন ছেয়ে যায়, চোখের কোণে মনের অজান্তেই কখনও কখনও জল জমে যায়। ধরুন যে বা যার সঙ্গে এ মাত্র কথা হলো দূরালাপনীর মাধ্যমে কিংবা সম্মুখে দেখা তার বা তাদের সঙ্গে কি ফের দেখা কিংবা কথা হবে কিনা এমন সংশয় জাগানিয়া একটা ছায়া পড়ে মনের ওপর। ছোটবেলা থেকেই 'মহামারি' শব্দটি শুনে আসছি আমরা। কিন্তু এর রূপ এত ভয়ঙ্কর হতে পারে চলমান পরিস্থিতির মুখোমুখি না হলে তাও অজানা-অচেনাই থেকে যেত। প্রায় সমগ্র বিশ্ব আজ একসঙ্গে মহামারি আক্রান্ত। করোনাযুদ্ধ জয়ে প্রচেষ্টা চলছে প্রাণপণ। কিন্তু এখন বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এও প্রশ্ন জাগে কিংবা ভঙ্গুর মনে উপলব্ধি হয় প্রকৃতি কি প্রতিশোধ গ্রহণ করে আপন চলার পথ খুঁজে নেবে? মনে পড়ছে আমাদের এক তরুণ কবির একটি কবিতার কয়েকটি কাব্য-পঙ্‌ক্তি। তিনি লিখেছেন, 'লেপ্টে দিল শরীরের সব কটা ইন্দ্রিয়ের দরোজায়,/মানব পাপের বোঝা বয় বসুমতি!/নিউটনের থার্ড ল' বুঝিয়ে দেবেই/প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবেই।'
ইংরেজি 'প্রেডিকশন' শব্দটি আমরা প্রায়ই নানা ক্ষেত্রে নানা রকম প্রয়োজনীয়তার নিরিখে ব্যবহার করে থাকি। বলতে গেলে বর্তমান প্রায় ভার্চুয়াল বিশ্বে অনেক ধারণাকেই নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। মানুষের সৃষ্ট নানা রকম দেয়াল কিংবা কাঁটাতারের বিভাজন ডিঙিয়ে মানুষই মানুষের প্রতি সহানুভূতি-সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে। শত নিরাশার মধ্যেও এ এক বড় আশা। একই সঙ্গে এও লক্ষণীয়, অনেক ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকভাবে ভিন্ন ও মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। মানবজাতিকে এই পরিবর্তনের জন্য নতুন করে তৈরি কিংবা প্রস্তুত হতে হচ্ছে। এ যেন এক অদ্ভুত ট্রান্সফরমেশন। অনেক বরেণ্যজনই ইতোমধ্যে বলেছেন, 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কভিড-১৯ বিশ্বের কাছে সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জ। এত বড় যুদ্ধ, এত কঠিন যুদ্ধ মানবজাতিকে একই সঙ্গে লড়তে হয়নি। এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষ চোখের আড়াল থেকে আক্রমণ করছে।' সন্দেহ নেই যথার্থ মন্তব্য। এর যথার্থতা মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
করোনার অভিঘাতে সমগ্র বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যস্ততা উদ্বেগের আর একটি ভয়াবহ ভিন্ন মাত্রা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ গোটা বিশ্বে যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে তাতেও দুশ্চিন্তা, অবসাদ ও নানামুখী মানসিক চাপ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আত্মহত্যার মতো প্রবণতাও এ কারণে বাড়ছে- এই বার্তাটি অধিকতর উদ্বিগ্ন না করে পারে না। পাশাপাশি অর্থনীতিতে যে প্রবল ধাক্কা লেগেছে বিশ্বব্যাপী এও বিশ্বের দেশে দেশে জীবনকে স্তব্ধ করে দিয়েছে বা দিচ্ছে। এরই প্রেক্ষাপটে তর্ক উঠেছে- জীবন আগে না জীবিকা আগে। এই তর্ক না জড়িয়েও অন্তত স্পষ্ট করেই এটুকু বলা যায়, করোনার ভয়ে আমরা হার মানব না- এই বাক্যটি উচ্চারণে যতটা সহজ প্রকৃতপক্ষে বাস্তবতা ততটা সহজ নয়। মনের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছেই। মানসিক স্বাস্থ্য বিরূপতার অভিঘাতে দুর্বল হচ্ছেই। ইউরোপসহ আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে মানসিক শক্তি ধরে রাখতে কিংবা মনের স্বাস্থ্য সবল রাখতে নিয়েছে নানা পদক্ষেপ।
মানুষের জীবনযাত্রায় বাধ্যতামূলক যে পরিবর্তন আসছে এবং আর্থ-সামাজিক বিবেচনায় পরিস্থিতি ক্রমেই যেদিক ধাবিত হচ্ছে এর শেষটা কি তা এখনও অজানা। জীবনের ছন্দ মিলিয়ে জীবনের সৌন্দর্যে মানুষ আবার কবে ফিরে আসতে পারবে তাও অনিশ্চিত। জীবনের সৌন্দর্যতা নির্ভর করে অনেক কিছুর ওপর। জীবনের ছন্দের তালও নির্দিষ্ট দু'একটা বিষয়ের ওপরই নির্ভরশীল নয়। করোনা-দুর্যোগ যখনই কাটুক, যখনই দূর হোক এই অমানিশা, জীবনে স্বস্তির ধারা যখনই আসুক বিশ্বায়নের প্লাবন যে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তাও ধারণার বাইরে নয়। বিদ্যমান বাস্তবতা এ প্রশ্নও তুলেছে- বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা কিংবা বিশ্বায়ন কতটা মজবুত? করোনার অভিঘাতে বহুমুখী ক্ষতির চিত্রই স্ম্ফীত হচ্ছে না একই সঙ্গে বিশ্বের নানা ক্ষেত্রে ছায়া ফেলে কোথায় কোথায় ক্ষত-অব্যবস্থাপনা-অদূরদর্শিতা-সীমাবদ্ধতা কিংবা দোষত্রুটি বিদ্যমান তাও দেখিয়ে দিয়েছে কিংবা দিচ্ছে। এর বাইরে আমরাও নই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সার্বিক এই ট্রান্সজিকশন পিরিয়ডে আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতি আমলে নিয়ে করণীয় সম্পর্কে কতটা কি করতে সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছেন? এমন প্রশ্নের মধ্যে আমাদের নীতিনির্ধারক কিংবা দায়িত্বশীল কেউ কেউ 'ধৃষ্টতা'র গন্ধ পেতে পারেন কিন্তু প্রশ্নটি বোধহয় অমূলক নয়।
মানসিক স্বাস্থ্যের সৃষ্ট ক্ষত ও জীবনের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার বিষয়ে দুর্যোগ মোকাবিলার পাশাপাশি দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনা সময়ের দাবি। আমাদের এমন পথ সন্ধান দরকার যা মানুষের মনে গেঁথে যাওয়া ভয়, হতাশা, দুর্দশা, খাদ্যাভাবের দুশ্চিন্তা ইত্যাদি নেতিবাচক সবকিছু প্রশমন করে। কারণ করোনার জটিল চশমায় অনেক কিছুই বড় বেশি ঝাপসা দেখাচ্ছে। চরম রহস্যজনক ও অমীমাংসিত করোনা বিপন্নতা বিপর্যস্ততা-ক্ষতি ও ক্ষতের সড়ক যে আরও চওড়া করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা আশাবাদী হবো, আশাবাদী থাকব, স্বস্তির পথ অনুসন্ধান করব এসবই সত্য বটে কিন্তু দুর্যোগ মুক্তির লক্ষ্যে চিকিৎসাসহ সংশ্নিষ্ট সবকিছুর পথ সর্বাগ্রে নিস্কণ্টক হবে। কথা নয় কাজের মধ্য দিয়ে সমস্যা সংকটের মোকাবিলা করতে হবে। তা না হলে মানসিক স্বাস্থ্যের পঙ্গুত্ব যেমন আরও বাড়বে তেমনি জীবনের সৌন্দর্যও পরাহত হবে। এই সত্যও অনস্বীকার্য যে, আমরা এক নতুন বিশ্বে পা রাখতে যাচ্ছি। আজকের চেনাজানা বিশ্ব ক্রমেই পাল্টে যাবে। মানবজাতি বিদ্যমান বাস্তবতায় বিশেষ কিছু শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়েছে। একদিকে পুরোনো কিছু অভ্যাস বিসর্জিত হয়েছে অন্যদিকে সংযোজিত হয়েছে নতুন অভ্যাস। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি তাতেও ঘটেছে। একই সঙ্গে ঘটেছে জীবনের অনেকটাই সৌন্দর্যহানি।
প্রত্যেক মানুষই নিজস্ব মানসিকতার ওপর নির্ভরশীল। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষে মানুষে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায় বটে কিন্তু প্রত্যেকের বাঁচার ধরন আলাদা, প্রকৃত অর্থে একেবারেই নিজস্ব। মনোবিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কে ভেবে দুর্যোগ ও দুর্যোগ-উত্তর মানসিক স্থিতিশীলতা তথা জীবনের হূত সৌন্দর্য পুনরুদ্ধারে গবেষণায় মনোযোগ বাড়িয়ে জনহিতকর পরামর্শের পথ বাতলাতে পারেন। মানুষ তার উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই জয়ী হয়েছে। ইতিহাস আমাদের দিকে। জয় হোক জীবনে।
deba_bishnu@yahoo.com
লেখক ও সাংবাদিক