- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- ভারত-চীন সংঘাত এবং আমাদের উদ্বেগ
ভারত-চীন সংঘাত এবং আমাদের উদ্বেগ
দক্ষিণ এশিয়া

কাশ্মীরের লাদাখ এলাকার গলওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারতের সীমান্তে ১৫ জুনের সংঘর্ষ দুই দেশের মধ্যে কয়েক মাস ধরে চলমান উত্তেজনা আরও উস্কে দিয়েছে। উভয়পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে সীমান্ত চুক্তি লঙ্ঘন করে সড়ক ও অন্যান্য সামরিক স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ তুলেছে। ভারতের অভিযোগ চীন ১৯৬২ সালের পর পশ্চিম হিমালয়ের পূর্ব লাদাখ ও আকসাই চীন পর্বতমালার ৩৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা অবৈধভাবে দখল করে আছে। অন্যদিকে চীনের অভিযোগ- ভারত তার উত্তর-পূর্বের ৩৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার দখল করে নিয়েছে। ভারতে ওই এলকাটি অরুণাচল রাজ্য নামে আর চীনে দক্ষিণ তিব্বত নামে পরিচিত। লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) অর্থাৎ হিমালয় মালভূমিসহ দীর্ঘ ৩৩৮০ কিলোমিটার বিরোধপূর্ণ এলাকাকে কেন্দ্র করে ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসের পর থেকে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বারবার মুখোমুখি হয়েছে। সীমানা নির্ধারণ না হওয়ায় ওই এলাকাটি নিয়ে সবসময় বিতর্ক ছিল।
প্রায় একই অবস্থা বিরাজ করছে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে চীনের সঙ্গে ১৬৪০ কিলোমিটারে সীমান্তে। ওই সীমান্তটি ভুটান থেকে শুরু হয়ে চীন-ভারত-মিয়ানমারের সংযোগস্থল পর্যন্ত বিস্তৃত। ওই সীমান্ত রেখাটি ম্যাকমোহন লাইন নামে পরিচিত। স্যার ম্যাকমোহন ১৯৩২ সালে সীমলা চুক্তির মধ্যস্থতা করেছিলেন। পরবর্তীকালে তার নামানুসারে এই সীমানা রেখার নামকরণ করা হয়। সিমলা চুক্তিতে স্যার ম্যাকমোহনের প্রস্তাব ছিল এই সীমানা রেখাটি ভারতের পূর্ব সীমান্ত থেকে তিব্বতকে পৃথক করবে। তিব্বতের প্রতিনিধিরা চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তৎকালীন চীন সরকার ওই চুক্তিকে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৬২ সালের সীমান্ত যুদ্ধে চীন সমগ্র বিবাদপূর্ণ এলাকাজুড়ে আক্রমণ করে। তারা পশ্চিমে আকসাই চীন ও পূর্বে লাদাখের কিছু অংশ দখল করে নিয়েছিল। একতরফা যুদ্ধবিরতির আগেই তারা পূর্বে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। চীন অবশ্য পশ্চিম দিক থেকে তার অবস্থান থেকে সরে যায়নি। ১৯৬২ সালের ২১ নভেম্বর যুদ্ধবিরতির পর উভয় বাহিনী যে স্থানে অবস্থান করেছিল তা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের মতো ভারত-চীন সীমান্ত কাঁটাতারের বেড়া, মাইনফিল্ডস, সার্চলাইট ও ওয়াচ টাওয়ার দ্বারা পৃথক নয়। ওই সীমান্তে চীন ও ভারতের সেনারা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেছিল এবং গত কয়েক দশকে সেখানে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। উভয় পক্ষের সম্মতিতে নির্ধারিত সীমান্ত চিহ্নটি সতর্কতার সঙ্গে মেনে চলছিল।
ভারত-চীনের মধ্যে আরেকটি বিবাদপূর্ণ এলাকা হলো সিকিম-তিব্বত সীমান্তের নাথু লা পাস। ১৯৬৭ সালে উভয় দেশের সেনার ওই এলকায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ায় দুই দেশের কয়েকশ' মানুষ সেখানে হতাহত হয়েছিল। ওই এলাকাটি বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় তা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ওই এলাকায় চীনা সৈন্য প্রবেশ করা মানে তা পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য হুমকি। স্বস্তির বিষয় হলো- ১৯৬৭ সালের পর ওই এলাকায় বড় কোনো সংকট তৈরি হয়নি। ওই পথটি আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের মূল পথ ও পর্যটকদের আকর্ষণস্থলে পরিণত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষের আগেও আন্তঃসীমানা বিরোধ সত্ত্বেও চীন-ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়। চীনের কমিউনিস্ট সরকারকে সমর্থন জানানো প্রথম দেশগুলোর মধ্যে ভারত অন্যতম। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও চীনকে সমর্থন দিয়েছিল ভারত। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তারা ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ, মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসের ও যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে মিলে ১৯৫৫ সালে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন শুরু করার ক্ষেত্রে গুরুত্বর্পূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারা পঞ্চশীল বা পাঁচটি নীতি গ্রহণ করেছিলেন যা অন্যদের মধ্যে একে অপরের আঞ্চলিক অখণ্ডতা, পারস্পরিক আগ্রাসন বন্ধ, হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯৬২ সালের সীমান্ত যুদ্ধের পর প্রধানমন্ত্রী নেহরু মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার আগেই যুদ্ধের পরপরই ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল থাপা এবং প্রতিরক্ষা প্রধান ভি. কে. কৃষ্ণ মেনন পদত্যাগ করলে ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে নতুন ভাবে সাজানো হয়।
বর্তমানে যে সংঘাত চলছে এর পেছনে বেশকিছু বৈশ্বিক কৌশল কাজ করছে। বৈশ্বিকভাবে চীন উদীয়মান পরাশক্তি। দেশটি তার সীমানায় শক্তি বৃদ্ধি করেছে। চীন দক্ষিণ চীন সাগরে একতরফাভাবে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের (ইইজেড) সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে যা উপকূলবর্তী দেশগুলো তথা ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার জন্য উদ্বেগের কারণ। চীন ওই এলাকায় তার নৌশক্তি বাড়ানোর পর যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অন্যান্য দেশগুলোও তাদের শক্তি বাড়িয়েছে। ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরেও চীন ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে শক্তি বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত চীনের সামুদ্রিক আধিপত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে চীন তার 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' (বিআরআই) বাস্তবায়ন করছে, যার লক্ষ্য বেইজিংয়ের সঙ্গে বৈশ্বিক যোগাযোগ তৈরি করা। পাকিস্তান বিআরআইর অন্যতম অংশীদার। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে যাওয়া চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) উভয় দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে ভারত আপত্তি তুলেছিল। ভারতের দাবি ওই করিডর তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে গেছে। চীন ও ভারত বড় আকারে বাণিজ্যিক অংশীদার হলেও তারা যে ধরনের কূটনৈতিক ও সামরিক নীতি গ্রহণ করেছে তা সামরিক সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।
লাদাখ এলাকায় উভয় দেশ সড়ক ও সেতু নির্মাণ করার কারণেই মূলত বর্তমানে সংকট শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে উভয় দেশই একে অন্যের বিরুদ্ধে সীমানা লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। চীন গলওয়ান উপত্যকা দিয়ে জিনজিয়াং থেকে লাসা পর্যন্ত মহাসড়ক নির্মাণ করেছে। ভারতও তার সেনাদের সিয়াচিনে যাতায়াতের জন্য লেহ থেকে কারাকরাম পর্যন্ত একটি মহাসড়ক নির্মাণ করেছে। অধিকৃত গলওয়ান উপত্যকা থেকে চীন সহজেই ভারতের ওই মহাসড়কে যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটাতে পারবে এবং নিজেদের সড়কের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে। সাম্প্রতিক উত্তেজনার পর উভয় পক্ষই সংযত হওয়ার আহ্বান জানালেও সীমান্ত সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে। উভয় দেশই সীমান্তের কাছে বিমানঘাঁটি ও সেনা ঘাঁটি বানিয়েছে। সেখানে সর্বাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধবিমান ও মিসাইল মোতায়েন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটবর্তী বিমানঘাঁটিগুলো যেমন- বাগডোগড়া, হাসিমারা, তেজপুর, দিব্রুগড় এতদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকলেও সম্প্রতি এগুলোর ব্যাপক সংস্কার করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিমানঘাঁটি হিসেবে অরুণাচলের পানশিহাটে সুখোই-৩২ এমকে বিমান পাঠানো হয়েছে।
বর্তমানে গোটা বিশ্ব কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এ সময়ে যে কোনো মূল্যে ভারত-চীনের সশস্ত্র্প সংঘাত এড়ানো দরকার। চীন-ভারত উভয় দেশই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই অর্থনৈতিক মন্দায় রয়েছে। উভয় দেশের অভ্যন্তরেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে যেগুলো অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে সমাধান করা দরকার। চীন-ভারত যুদ্ধ পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর কাছে সুসংবাদ হলেও তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বড় বাধা হবে।
ভারত ও চীন উভয় দেশই আমাদের অর্থনৈতিক অংশীদার। তারা আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অনেক অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কেও ক্ষেত্রে কিছু নেতিবাচক দিক আছে। যেমন রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের সমর্থন না থাকা, অব্যাহত সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর ন্যায় সঙ্গত হিস্যা না হওয়া, এনআরসি ইস্যু এবং তথাকথিত অবৈধ অভিবাসীদের বাংলাদেশি বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে 'নেইবারহুড ফার্স্ট' স্লোগান দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটেনি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনও আমাদের হতাশ করেছে; প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনা ভেটো মিয়ানমারের পরিকল্পিত গণহত্যাকে আরও উস্কে দিয়েছে। সুসম্পর্ক সত্ত্বেও কিছু বিষয়ে দুই দেশই আমাদের হতাশ করেছে। তার পরও আমাদের সব ধরনের বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির নীতি অব্যাহত রাখতে হবে এবং সব পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানাতে হবে।
নিরাপত্তা বিশ্নেষক; অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর ট্রেজারার, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক
মন্তব্য করুন