জরিপ
করোনাকালে কর্মজীবী নারীর কর্মস্থল বনাম গৃহকোণ

তাহমিনা সুলতানা
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২০ | ১৫:০৭
অঘোষিত লকডাউন চলাকালে কর্মজীবী নারীরা কীভাবে কর্মস্থল আর বাড়িতে সময় দিয়েছেন, তা নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট একটি অনলাইন জরিপ পরিচালনা করেছে, যেখানে ২২২ জন কর্মজীবী নারী অংশগ্রহণ করেন। এতে দেখা গেছে কর্মজীবী নারীর কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনে করোনার প্রভাব বিস্তর। এ সময় তাদের পারিবারিক জীবনে কাজের চাপ বেড়েছে, কেননা বাড়িতে তখন সব সদস্যের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি ছিল। পরিবারের কম বয়সী সদস্যদের স্কুল-কলেজ বন্ধ, গৃহপরিচারিকাদের ছুটি। সুতরাং বাড়তি চাপ হচ্ছে রান্না, কাপড় ধোয়া, হাঁড়ি-পাতিল মাজা, বাড়িঘর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখা, ছোটদের লেখাপড়ার তদারকি, বয়স্কদের যত্নসহ নানাবিধ কাজ।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ৩৬ বছর, ৮১ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর; ১৩ শতাংশ স্নাতক এবং বাকি ছয় শতাংশ ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী। তাদের মধ্যে ২৮ শতাংশ সরকারি খাতে আর ৭২ শতাংশ বেসরকারি খাতে কাজ করছেন এবং ৭৭ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের এই লকডাউনের সময়ও বাড়িতে বসেই নিয়মিত অফিসের কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছে। দেখা গেছে, সরকারি খাতের (১৯ শতাংশ) চেয়ে বেসরকারি খাতে (৫৮ শতাংশ) নিয়োজিতরা বাড়িতে বসে নিয়মিত অফিসের কাজ করেছেন। ১০ শতাংশ জানিয়েছেন রোস্টারের মাধ্যমে অফিসে গিয়ে কাজ করার কথা।
নিয়মিত অফিসের কাজ করতে হচ্ছে এমন ২২ শতাংশকে সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়েছে; ২১ শতাংশকে স্বাভাবিক অফিস সময় অনুযায়ী ঘরে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, ১০ শতাংশকে নির্ধারিত দিনে কর্মস্থলে উপস্থিত থেকে কাজ করতে হয়েছে; ১৫ শতাংশ আগের চেয়ে কম কাজ করেছেন; ৩৫ শতাংশ নিজের সুবিধা অনুযায়ী সময়ে অফিসের দায়িত্ব পালন করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা কাজগুলো অনলাইনে করেছেন।
কর্মজীবী নারীদের গৃহকাজেও সময় দিতে হয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। ৬৫ শতাংশকে আগের চেয়ে রান্নায় বেশি সময় দিতে হয়েছে, ৭২ শতাংশকে ধোয়া-মোছার কাজে আর ৭৮ শতাংশকে বাড়িঘর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করার কাজে আগের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে। ৭৫ শতাংশ বলেছেন, গৃহস্থালি কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেয়েছেন।
মজার বিষয় হলো ৮৭ শতাংশ কর্মজীবী নারী মনে করছেন, করোনাকাল তাদের ব্যক্তিগত জীবনে সুফল এনেছে। এ সময়ে তারা পরিবারকে নিজের মতো করে সময় দিতে পেরেছেন। একজন কর্মজীবী মা বলছেন, তার একমাত্র সন্তানের বয়স এখন বারো বছর এবং এই প্রথম তিনি তার মেয়ের সঙ্গে এত দীর্ঘ সময় কাটাতে পারছেন।
অন্যদিকে ৮২ শতাংশ মনে করছেন, করোনাকাল তাদের পারিবারিক জীবনে অনেক ক্ষতিসাধন করেছে। যেমন চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে; যার ফলে মানসিক দুশ্চিন্তা, হতাশা ও বিষণ্ণতার মতো সমস্যা সৃষ্টি করছে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে তাদের আচরণে। তাদের অনেকেই স্বামী, সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেছেন।
কর্মজীবী নারীদের অনেকেই বলছেন করোনাকালে বাড়িতে থেকে অফিসের কাজ করা হচ্ছে ২৪/৭ এর মতো। নির্দিষ্ট সময় মেপে কাজ করা যায় না। এমনকি ছুটির দিন আর কাজের দিনের মধ্যেও পার্থক্য করা যায় না। তারা মনে করছেন, কর্মস্থলের কাজ কর্মস্থলেই সম্পন্ন করা ভালো নতুবা গৃহকর্মের সঙ্গে এর সংঘাত লাগতে বাধ্য। ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ চাইছেন বাড়িতে থেকেই অফিসের কাজ করতে আর বাকি ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ কর্মস্থলে উপস্থিত হয়ে কাজ করতে। যদিও বাড়িতে থেকে কাজ করলে যাতায়াতের জন্য যে সময়, শ্রম এবং অর্থ খরচ হতো, সেটি এ সময়ে আর লাগেনি। এটুকু বেঁচে যাওয়া সময় আর শ্রম দিয়েই তারা একই সঙ্গে পারিবারিক কাজের চাপ সামলে নিতে পারছেন। ২৩ শতাংশ চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন; ১৮ শতাংশ বেতন পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন; ৪৬ শতাংশ করোনা-পরবর্তী কাজের চাপ, সামাজিক ও পারিবারিক নানা বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
এ সময়ে মানসিক চাপ কমবেশি সবারই ছিল। ৪৮ শতাংশ প্রথম উদ্বেগ হিসেবে পরিবারের সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কার কথা বলেছেন; ২৪ শতাংশ দ্বিতীয় উদ্বেগ হিসেবে নিজের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কার কথা বলেছেন; ১৮ শতাংশ তৃতীয় উদ্বেগের কারণ হিসেবে ঘরবন্দি জীবনে দম বন্ধ অবস্থার কথা বলেছেন। ৬৫ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের ঘুমের সমস্যা হয়েছে। ৯০ শতাংশের বেশি অংশগ্রহণকারী মনে করছেন, করোনা বিষয়ক নিয়মিত খবর শোনা তাদের মানসিক চাপ তৈরি করেছে। বেশিরভাগই বলেছেন যে, তারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন; যেমন- বই পড়া, বাগান করা, গান শোনা, সিনেমা দেখা, নতুন নতুন পদের রান্নার চেষ্টা করা, পরিবারের সঙ্গে বিশেষ করে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানো। ফলে মানসিক চাপ কম অনুভূত হয়েছে।
আমরা কেউই জানি না এই পরিস্থিতির কবে সমাপ্তি ঘটবে আর আমরা আগের জীবনে ফিরে যাব! গুগল, টুইটারের মতো প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই তাদের কর্মীদের বাড়িতে বসে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে; কেননা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কর্মীদের সুস্থতা নিশ্চিত করাও প্রতিষ্ঠানের নৈতিক দায়িত্ব। তাই আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা এই গবেষণার ফলাফলের আলোকে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। যেমন- কর্মক্ষেত্রের সময়সীমায় পরিবর্তন আনতে পারেন বা দিনে দুই বা তিন শিফটের ব্যবস্থা চালু করতে পারেন। ফ্লেক্সিবল অফিস আওয়ারের কথা ভাবতে পারেন, যাতে সবাই একসঙ্গে অফিসে না গিয়ে সামাজিক দূরত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেন। আবার বাড়িতে বসে অফিসের কাজ করার ব্যবস্থাকেও অনুমোদন দিতে পারেন। এই পরিস্থিতির সঙ্গে যত দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়া যাবে, ততই অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
উপপরিচালক (গবেষণা), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট
- বিষয় :
- জরিপ
- তাহমিনা সুলতানা