বিশ্বের জনবহুল শহরগুলোতে মেট্রোরেল বেশ জনপ্রিয় গণপরিবহন। দেরিতে হলেও নগরবাসীকে দুর্বিষহ যানজট থেকে স্বস্তি দিতে এবং গণপরিবহনের সক্ষমতা বাড়াতে নির্মাণ করা হচ্ছে মেট্রোরেল। তিলোত্তমা ঢাকার উত্তরা খেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রো-রুটের কাজ এগিয়ে চলেছে। সম্প্রতি বৈশ্বিক মহামারি করোনায় দেশে দেশে হোঁচট খাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। যাপিত জীবনের চিরচেনা কোলাহলে ভর করে অজানা ভয় আর শঙ্কার অমানিশা। গতি হারায় উন্নয়নের চলমান ধারা, থমকে যায় অর্থনীতির প্রবহমানতা। এরই মধ্যে প্রাথমিক আঘাত সামলে নিয়ে জীবনের প্রয়োজনে জীবিকার রথ চলতে শুরু করেছে। গতি হারানো উন্নয়ন কাজ পেতে চলেছে গতি। এ বাস্তবতায় স্বপ্নের মেট্রোরেল প্রকল্পও নড়েচড়ে বসেছে।
উন্নয়ন একটি প্রবহমান প্রপঞ্চ। জীবনের মতোই উন্নয়ন সতত বহমান। উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থবিরতা মানে জীবনের প্রবহমানতা থমকে যাওয়া। অনেক বিদেশি নাগরিক কর্মরত থাকায় করোনার এ সময়ে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়া ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি চলমান কাজে গতি সঞ্চার করতে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে বেশকিছু পদক্ষেপ। স্বাস্থ্যবিধি এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করতে হলে জনবলকে প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রকল্প এলাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে আবাসিক স্থাপনা। পাশাপাশি জনবলকে কাজে নিয়োগের লক্ষ্যে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নমুনা সংগ্রহ করে কভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়। নমুনা পরীক্ষায় যাদের পজিটিভ ফল আসে, তাদের রাখা হয় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে। এরপর নিয়োগ করা হয় কাজে। চলমান পরিস্থিতিতে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ আরও এক ধাপ এগিয়ে প্রতিটি প্যাকেজে বারো থেকে পনেরো শয্যার একটি করে ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে দুটি ফিল্ড হাসপাতালের নির্মাণকাজ শেষ হতে চলেছে।
চলমান মেট্রোরেল রুট-৬ এর পাশাপাশি সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে আরও পাঁচটি রুট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে গ্রহণ করেছে সমন্বিত পরিকল্পনা। এর আওতায় সাতষট্টি কিলোমিটার উড়াল এবং একষট্টি কিলোমিটার পাতালসহ একশ' আটাশ কিলোমিটারের শক্তিশালী মেট্রো নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে। রুট-৬ এর পাশাপাশি দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও দুটি রুট নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছে সরকার। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাড্ডা-রামপুরা হয়ে কমলাপুর রেলস্টেশন এবং প্রগতি সরণির নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল নতুন শহর হয়ে পিতলগঞ্জ পর্যন্ত একত্রিশ কিলোমিটার দীর্ঘ রুট-১ বাস্তবায়নের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। একনেকে অনুমোদিত এ প্রকল্পের ইতোমধ্যে বিভিন্ন সমীক্ষার কাজ শেষে বিস্তারিত নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে। এ রুটের পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীর পূর্ব-পশ্চিমে সংযোগ বাড়াতে হেমায়েতপুর থেকে মিরপুর-১০ হয়ে বনানী-গুলশান পেরিয়ে ভাটারা পর্যন্ত চলে যাবে মেট্রো রুট-৫ এর নর্দার্ন রুট। সম্প্রতি এ রুটের নকশা প্রণয়নসহ প্রাথমিক কাজ সম্পাদনে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরও তিনটি রুটের নির্মাণকাজ শুরুর লক্ষ্যে প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করেছে ডিএমটিসিএল।
দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্পটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড-ডিএমটিসিএল আটটি প্যাকেজে বাস্তবায়ন করছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল দুটি অংশে ভাগ করে এগিয়ে চলছে চলমান রুট-৬ এর কাজ। এরই মধ্যে প্রথম অংশের বাহাত্তর শতাংশ এবং দ্বিতীয় অংশের চল্লিশ শতাংশ পূর্ত কাজ শেষ হয়েছে। জাইকার অর্থায়নে প্রায় বাইশ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সংবলিত এটি একটি ফার্স্টট্র্যাক প্রকল্প। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রুটে থাকছে ষোলোটি স্টেশন। প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর বারো সেট ট্রেন চলবে এ রুটে। প্রতি ঘণ্টায় উভয় দিকে ষাট হাজার যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা নিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বছরে অর্থাৎ আগামী বছর বিজয় দিবসে মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক অপারেশন শুরুর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। করোনা মহামারির প্রভাব মোকাবিলা করে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশে মেট্রোরেল প্রকল্প মডেল হতে পারে। সফলভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নগরবাসী যানজট থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে বলে জনপ্রত্যাশা।
nasertipu007@gmail.com