
চাকরির চিরন্তন মোহ বা জনপ্রিয়তা আজও বর্তমান, বিশেষ করে সাধারণ ধরনের চাকরি। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক চাকরি বা কর্মের চাহিদা বা আকর্ষণ ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও তা আশানুরূপ নয়। গ্রামে গেলে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এসে ভিড় করে শহরে তাদের চাকরি দেওয়ার জন্য। কী করতে পারে বা কী শিখেছে জিজ্ঞেস করলে বলে আইএ, বিএসসি বা বড়জোর অনার্স পাস। কম্পিউটার, ইলেক্ট্রিক, ইলেক্ট্রনিক্স বা কৃষিকাজ জানে কিনা জিজ্ঞেস করলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সারাদিন ঘুরে বেড়ায়; বিদেশ থেকে ভাই, বাবার পাঠানো টাকায় চা দোকানে বসে আড্ডা দেয়; অথচ পৈতৃক জমি অনাবাদি বা পতিত পড়ে থাকে।
করোনা মহামারির কারণে অনেক শ্রমিক-কর্মচারী ইতোমধ্যে বিদেশ থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন, অনেকে পাইপলাইনে আছেন বা আসার সুযোগ খুঁজছেন। আবার অনেকে পরিস্থিতি অবলোকন করছেন। দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা কমবেশি ২৭ লাখ ধরা হয়। তবে প্রচ্ছন্ন বেকারের (অর্থাৎ কর্মের সুযোগ না থাকায় দু'জনের কাজ তিনজনে সম্পাদন করলে একজন প্রচ্ছন্ন বেকার) সংখ্যা হিসাব করলে এ সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে নিঃসন্দেহে। যারা বিদেশ থেকে দেশে ফেরত এসেছেন বা আসবেন, তাদের জন্য ২৭ লাখ বেকারের সঙ্গে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করারও প্রয়োজন হবে।
এদিকে করোনা পরিস্থিতি স্বল্প সময়ের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালো বা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হলেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে বেশ সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। এ সময়ে শ্রমিক আমদানিকারক দেশগুলোর শ্রমিকের চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পাবে। তাছাড়া চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতার কারণে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা শূন্যের কোঠায় নেমে আসতে পারে। এ ত্রিবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা কীভাবে অগ্রসর হবো? করোনা পরবর্তীকালে বিশ্বে মন্দাভাব দেখা দিলে বা বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকোচন নীতি অনুসরণ করা হলে অনুমান করা যায়, দক্ষ শ্রমিক ব্যতিরেকে অদক্ষ শ্রমিকদের বিদেশে অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে যেতে পারে।
সম্প্রতি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের (টিভেট) ওপর বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্যান্যের মধ্যে প্রবাসী কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানো এবং টিভেট কর্মসূচিতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। টিভেট নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড দ্বারা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) সব ধরনের দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম তদারকি ও পরিবীক্ষণ করে থাকে। এ কর্তৃপক্ষের তদারকিতেই কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কাজ করে।
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি ২০১১-তে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে টিভেটে শিক্ষার্থী ভর্তি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ২০ শতাংশে উন্নীত করা হবে যা তখন প্রায় ৩ শতাংশ ছিল এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে। ওই নীতির ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য যা করা দরকার তা বিস্তারিত উলেল্গখ রয়েছে। এ ছাড়াও ১৯৬৭ সালের কারিগরি শিক্ষা আইন, জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০ সব কিছুতেই টিভেটের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় ৩৩টি প্রকৌশল ট্রেড/প্রযুক্তিতে বিভিন্ন মেয়াদে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সরকারি-বেসরকারি প্রায় সাত হাজার ৭৭৩টি প্রতিষ্ঠানে সাত লাখ ১৪ হাজার ৬৪৪টি আসন রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ আসন সরকারি প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। তবে সনদ প্রদানের এখতিয়ার রয়েছে শুধু কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের। ধীরে ধীরে টিভেটে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে। দেখা যায় ২০০৮ সালে চার লাখ ৪৫ হাজার ৩৫৯ থেকে ছাত্র ভর্তি ২০১২ সালে সাত লাখ ৪৪ হাজার ৭৭৮ জনে এবং ২০১৮ সালে ১২ লাখ ৬২ হাজারে ৭৬২ জনে উন্নীত হয়।
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিসহ বিভিন্ন দলিলে সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে নারীদের টিভেটে অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়েছে। নারীদের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও এখনও সরকারি এবং বেসরকারি ইনস্টিটিউটগুলোতে নারী শিক্ষকের হার ২০ দশমিক ৯১ ভাগ, আর ছাত্রীর হার ২৯ দশমিক ৫৪ ভাগ। নারী শিক্ষার হার আমাদের যে গতিতে বাড়ছে, সেই গতিতে টিভেটে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে না। ফলে অদক্ষ নারীরা গৃহকর্ম বা পোশাক শিল্পকেই একমাত্র অবলম্বন হিসেবে বেছে নিচ্ছেন।
দেশ এবং বিদেশের দক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীর চাহিদা নিরূপণের কোনো পদ্ধতি বা গবেষণা নেই। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোক্তা, শিল্প বা কৃষি শিল্প মালিকদের সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডসহ দক্ষতা উন্নয়নকারী কর্তৃপক্ষের বা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবিড় যোগসূত্র দরকার। একদিকে কোন ট্রেডের কতজন, কোন স্তরের বা পর্যায়ের শিক্ষা বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক দরকার তার যেমন গবেষণা এবং জরিপ দরকার, অন্যদিকে ফি বছর কোন ট্রেডে কোন বিষয়ে কতজন কোন স্তরের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তা উদ্যোক্তা, মালিক তথা চাকরিদাতাদের জানা দরকার। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতির ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে শিল্প দক্ষতা কাউন্সিল গঠন করার বিধান রাখা হয়েছে। শিল্পে কী ধরনের কী পরিমাণ এবং কখন দক্ষ শ্রমিক প্রয়োজন এবং তার সরবরাহ বা জোগান নিশ্চিত করার বিষয়ে যোগাযোগ ও সমন্বয় করার জন্য এ কাউন্সিল গঠন করার কথা বলা হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ টিভেটকে কার্যকর ও ব্যবহারোপযোগী করতে হলে সর্বাগ্রে দরকার শিল্পক্ষেত্রের উপযোগী টিভেট কারিকুলাম প্রণয়ন এবং সময়মতো আধুনিকীকরণ করা, শিক্ষার্থীদের যথাযথ ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিশ্চিত করা এবং সময়মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়োগ করা। আরও প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্মত প্রয়োজনীয় ল্যাব বা কারখানা স্থাপন করা, যেসব টিভেট শিক্ষক প্রশিক্ষকের শিক্ষাগত জ্ঞান, ব্যবহারিক দক্ষতা যথাযথ নয়, তাদের শিল্প, কৃষি বা সেবা সেক্টরে কর্ম-অভিজ্ঞতা বা কর্ম সম্পর্কে জ্ঞান বা চাক্ষুষ পরিদর্শনের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা। টিভেটের আওতায় বার্ষিক প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী কোর্স শেষ করে বের হন; কিন্তু তা দিয়ে বৈদেশিক এবং অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। এতে দেশীয় উদ্যোক্তারা দক্ষ শ্রমিকের অভাবে বেকায়দায় পড়েন, বৈশ্বিক বাণিজ্যে পণ্যের গুণগত মানের উৎকর্ষ এবং দ্রব্যমূল্যের প্রতিযোগিতায় অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে পড়েন। অন্যদিকে দেশে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিক-কর্মচারী স্বল্পতার কারণে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও বিদেশি উদ্যোক্তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।
টিভেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ওয়ার্কশপ, শিক্ষা প্রশিক্ষণ উপকরণ, আধুনিক সুবিধা সংবলিত ক্লাসরুম নেই। রাজস্ব বাজেটের আওতায় প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ কম থাকায় এবং উন্নয়ন বাজেট তথা প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ পরিচালিত হওয়ার কারণে সারাবছর প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালিত হয় না। আমাদের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠক্রমে শুধু তাত্ত্বিক পাঠদান করা হয়, দক্ষতা বা ব্যবহারিক জ্ঞানদানের সুযোগ বা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ফলে শিক্ষার্থীদের ডিপ্লোমা বা গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে এসে দক্ষতা ও ব্যবহারিক জ্ঞানার্জনে হিমশিম খেতে হয়।
জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিতে অভ্যন্তরীণ শিল্প ও কলকারখানায় চাওয়া দক্ষতা নিরূপণের জন্য কমিটি গঠনের মতো আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে চাওয়া দক্ষতার গতি-প্রকৃতি নিরূপণ ও দক্ষ শ্রমিক জোগানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ প্রদানের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ ও অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা যেতে পারে। বিদেশে দক্ষ নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্র ও পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারেও এ কমিটি সমন্বয় ও সুপারিশ করতে পারে। বর্তমানে টিভেটে হেলথ টেকনোলজি এবং মেডিকেল আল্ট্রাসাউন্ড কোর্স চালু আছে। এ দেশে প্রায় ২০ লাখ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এবং প্রায় ১২ লাখ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। টিভেটে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কোর্স চালু করা হলে দেশ এবং বিদেশে মেয়েরা উপযুক্ত চাকরি পেতে পারে।
অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমবাজার চাহিদা, বিদেশ চাহিদা ছাড়াও মাঝে মাঝে প্রয়োজন অনুসারে সমাজে পিছিয়ে পড়াদের উপযোগী, বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর উপযোগী, উদ্ভাবন সহায়ক, নারী-পুরুষ উপযোগী, উপকারভোগীদের চাহিদাসম্মত, বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সঙ্গে মানানসই করার লক্ষ্যে টিভেটকে হালনাগাদ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত সচিব; প্রাক্তন রেক্টর
বিসিএস প্রশাসন একাডেমি
মন্তব্য করুন