রাজধানীর পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে নির্লিপ্ততা ও সমন্বয়হীনতার খবর সমকালে এমন সময় প্রকাশ হলো যখন একদিকে বর্ষাকাল চলমান, অন্যদিকে ধেয়ে আসছে বন্যা। উপরন্তু রাজধানীর বিস্তীর্ণ অংশজুড়ে চলছে মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ। আবার আবহাওয়াবিদরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকায় এবার বর্ষাকাল হতে পারে প্রলম্বিত ও বৃষ্টিমুখর। সবমিলিয়ে এই বর্ষায় রাজধানীতে জলাবদ্ধতা ও জলজট সম্প্রসারণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। রোববার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মিলে এমন ৬০টি এলাকা রয়েছে, যেখানে পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা ঝুঁকিতে রয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে এমনিতেই রাজধানীর জনজীবন বিপর্যস্ত। বিশেষত নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি রয়েছে কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে। এর ওপর যদি নগরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়, তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ছাড়া আর কী হতে পারে? আমরা জানি, ঢাকা 'প্রাকৃতিকভাবেই' ছিল জলাবদ্ধতাবিহীন নগরী। এর চারপাশ ও অভ্যন্তরে প্রবাহিত একাধিক নদী এবং অর্ধশতাধিক খাল তো ছিলই, উপকণ্ঠজুড়ে ছিল বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল। ফলে এই নগরীতে জলাবদ্ধতা সহজ ছিল না। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নদী দখল, খাল ও নিম্নভূমি ভরাট সেই জলাবদ্ধতাকেই যেন নিয়তি করে তুলেছে। প্রতিবছরই আমরা দেখি, বর্ষাকাল এলে জলাবদ্ধতা নিয়ে ভোগান্তি হয়, তা দূর করার জন্য প্রতিশ্রুতি মেলে; কিন্তু জলাবদ্ধতা আর দূর হয় না। বরং বছর বছর বাড়তে থাকে এর পরিধি ও স্থায়িত্ব। আমরা মনে করি, এখনও টিকে থাকা খালগুলো যদি সচল রাখা যায়, তাহলে জলাবদ্ধতা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণে আসতে বাধ্য। দুর্ভাগ্যবশত এই খালগুলো উদ্ধার বা সচল রাখতে সমন্বয়হীনতা কতটা প্রকট তা স্পষ্ট হয়েছে সমকালের কাছে দেওয়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের বক্তব্যে। তিনি রাজধানীর একটি খালের উল্লেখ করে বলেছেন, এর দেখভালের দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের। কিন্তু তারা খালটি পরিস্কার করেনি। ফলে উত্তর সিটি করপোরেশন নিজস্ব অর্থায়নে এ কাজ করছে। অবশ্য বেশিরভাগ খাল যে সংস্থার দায়িত্বে রয়েছে, সেই ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বহীনতা আরও মহাকাব্যিক। শুধু খাল ও নালা পরিস্কার রাখার জন্য যদিও এই সংস্থার একটি সার্কেল রয়েছে, কোনো বছরই তারা সন্তোষজনক চিত্র দেখাতে পারে না। পত্রিকান্তরে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, প্রায় সাড়ে পাঁচশ' কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালে 'ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও খাল উন্নয়ন প্রকল্প' গৃহীত হলেও এর অগ্রগতি হতাশাজনক। এর আওতায় ১৬টি খাল উন্নয়নের কাজ চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২০ শতাংশ কাজও সম্পন্ন হয়নি। আর শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে প্রকল্প সম্পন্ন কেন করা হয়, সেই কারণ আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না। এর অর্থ, ঢাকার পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা সচল না থাকা বা বছর বছর জলাবদ্ধতায় রাজধানী অচল থাকার কারণ অর্থায়নের অভাব নয়। বরং সংশ্নিষ্টদের আন্তরিকতা ও দক্ষতারই অভাব এভাবে নগরবাসীকে নাকাল করে তোলে। আমাদের প্রশ্ন, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের কারণে জলাবদ্ধতার জনদুর্ভোগ চলতেই থাকবে? সমকালের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। আমরা মনে করি, আসন্ন জলাবদ্ধতা এড়াতে বিলম্বে হলেও সব সংস্থার একযোগে কাজ শুরু করা উচিত। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কীভাবে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সব পক্ষ আন্তরিক হলে তা শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে না। আরও ভালো হয়, মন্ত্রণালয়সহ সব পক্ষ যদি মনে রাখে যে- দীর্ঘমেয়াদে হলেও রাজধানীর খালগুলো অন্তত উদ্ধার ও সচল করার বিকল্প নেই। এ ছাড়া যত প্রকল্পই নেওয়া হোক না কেন, স্থানীয় ও তাৎক্ষণিক যত কাজই করা হোক; জলাবদ্ধতা থেকে একদা জলাবদ্ধতাহীন এই নগরীর মুক্তি নেই।