- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- হজের তাৎপর্য ও চলতি পরিস্থিতি
হজের তাৎপর্য ও চলতি পরিস্থিতি

হজ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তম সমাবেশ। হজের আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা, কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা করা। শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট তারিখে মক্কার কাবাঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ (দৌড়ান), মিনায় অবস্থান প্রভৃতি কতিপয় কার্য যেভাবে হজরত মুহাম্মদ (সা.) নির্ধারণ করে দিয়েছেন সেইভাবে সম্পাদন করার নাম হজ। এটি হলো ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের পঞ্চম।
হজের কতিপয় মৌলিক বিষয় হলো- ১. হজের নিয়ত, ২. ইহরাম বাঁধা, ৩. আরাফাতের মাঠে অবস্থান, ৪. মুযদালিফায় রাত্রিযাপন, ৫. মিনায় অবস্থান এবং শয়তানের প্রতি কঙ্কর নিক্ষেপ, ৬. কাবাঘর তাওয়াফ, ৭. হাজরে আসওয়াদে (কালো পাথর) চুমা দেওয়া, ৮. সাফা-মারওয়ায় সাঈকরণ, ৯. কোরবানি করা, ১০. মাথার চুল মুণ্ডন বা কর্তন।
হজের ইহরামের মাধ্যমে মানবজীবনের চূড়ান্ত পরিণতি যে এক খণ্ড সাদা কাপড় পরে আল্লাহপাকের দিকেই প্রত্যাবর্তন- এ সত্যকে জীবন্ত করে তুলে ধরা হয়েছে। কালো পাথরের স্পর্শ ও এর প্রতি ইঙ্গিতের মাধ্যমে তাওয়াফ শুরু করার দ্বারা অন্য সবকিছুর আনুগত্য ও গোলামি প্রত্যাখ্যান করে এক আল্লাহর উদ্দেশে বা জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা হতে হবে মুসলিম উম্মাহর সারাজীবনের কর্মপ্রয়াস। সাঈ বা দুই পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে সাতবার দৌড়ানোর মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমানকে নিরলস কর্ম-প্রচেষ্টা ও কর্ম-সম্পাদনের মাধ্যমে তার জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ৯ জিলহজ তারিখে আরাফাতে গমন, সেখানে সকল হাজির দিনের বেলায় অবস্থানের মাধ্যমে মানব সৃষ্টির সূচনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদকে মানব জাতির কল্যাণে নিয়োগ করার প্রতি গুরুত্বারোপ, মুজদালিফায় রাতে অবস্থানের দ্বারা (ইবাদত-বন্দেগি) চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে আত্মিক উন্নয়ন ঘটানো, যাতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুফলকে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে তথা জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত করা হয়। মানুষের মধ্যকার আমিত্ব ও আত্মকেন্দ্রিকতারূপী শয়তানকে পরাজিত করা ও আল্লাহপ্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য ১০ জিলহজ তারিখে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই মুজদালিফায় সংগৃহীত ৭০টি পাথর রূপী বুলেট মিনায় অবস্থিত তিনটি শয়তানি প্রতীকে নিক্ষেপের মাধ্যমে শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণার বিরুদ্ধে সদা সক্রিয় অবস্থানে নিয়োজিত থাকার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এ পাথর মারাই শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে ইবরাহিমি পন্থায় বিজয় বা কোরবানি ঈদোৎসবের মাধ্যমে সেদিনই উদযাপিত হয়ে থাকে।
হজের মাধ্যমে আসা পরহেজগারির পূর্ণতাই অন্যকে সৎ কাজের আদেশদান এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখার সক্রিয় কর্মী করে তোলে। হজের মহাসম্মেলন স্পষ্টত প্রমাণ করে যে, দীন সমস্ত দুনিয়ার জন্য এবং মুসলমানদের মধ্যকার বিভেদ-বিভ্রান্তি ও অনৈক্যের কারণগুলো হজের দর্শনের পরিপন্থি। তাই হজই হচ্ছে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করার একমাত্র সঠিক এবং সামগ্রিক শিক্ষা।
দুনিয়ায় যারাই এক আল্লাহর বন্দেগি করতে চাইবে এবং বাস্তব কর্মজীবনে তার আনুগত্য করে চলবে, তারা যে জাতি আর যে দেশেরই অধিবাসী হোক না কেন সকলেই একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রে প্রতি বছর এসে সমবেত হবে, এ জন্য হজ করার পন্থা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এ দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, চাকা যেমন নিজ অক্ষের চতুর্দিকে ঘোরে, মুসলমানদের জীবনও তেমনি আপন কেন্দ্রেরই চতুর্দিকে আবর্তিত হয়- এই গূঢ় রহস্যেরই বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে হজ।
হজ পালনের পুরো অনুষ্ঠানটা হলো একই সঙ্গে অনেক কিছুর মঞ্চায়ন বা প্রতীকস্বরূপ। যেমন সৃষ্টির মঞ্চায়ন, ইতিহাসের মঞ্চায়ন এবং সমগ্র ইসলামী উম্মাহর মঞ্চায়ন। হজ আনুষ্ঠানিকতার এই মঞ্চায়নে মহান আল্লাহ রয়েছেন মঞ্চ ব্যবস্থাপকের ভূমিকায়। আর সমবেত হাজিবৃন্দের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই মঞ্চায়নের মূল ভাবটি ফুটে ওঠে। হজরত আদম (আ.), হজরত ইব্রাহিম (আ.) হজরত হাজেরা (আ.) এবং পাপাত্মা শয়তান হলো এই মঞ্চায়নের মূল চরিত্রসমূহ। দৃশ্যপট হলো মসজিদুল হারাম, কাবার চতুর্দিক, আরাফাতের ময়দান, মাশআরুল হারাম এবং মিনা প্রান্তর। মূল প্রতীকগুলো হলো কাবা, সাফা-মারওয়া, দিন-রাত্রি, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, মূর্তি এবং কোরবানির আনুষ্ঠানিকতা। মঞ্চায়নের সাজ-পোশাক যেন ইহরাম, হালক এবং তাকসির। আর এই মঞ্চায়নের বিভিন্ন ভূমিকায় যে কার্যসম্পন্ন করে সে মাত্র একজন। হজের নিয়তে যিনি দাঁড়িয়েছেন অর্থাৎ আপনি নিজেই। আপনি নারী হোন বা পুরুষ হোন, যুবক বা বৃদ্ধ, সাদা কিংবা কালো- আপনিই হলেন এই অনুষ্ঠানের মূল। আল্লাহতায়ালার এবং শয়তানের দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে হজরত আদম (আ.), হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং হজরত হাজেরার (আ.) যে ভূমিকা সেটি আপনাকেই দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। তাই ব্যক্তি হিসেবে আপনাকেই এই আদর্শিক মঞ্চায়নের প্রধান চরিত্র বলা যায়।
এ বছর অবশ্য করোনা মহামারির কারণে বাইরের দেশ থেকে হজ করতে যাওয়ার সুযোগ থাকছে না। হজের সুযোগ পাবেন শুধু সৌদি আরবের বাসিন্দারা এবং দেশটিতে বসবাসরত বিদেশিরা। এক হাজারেরও কম মানুষের অংশ নেওয়ার সুযোগ হবে মুসলমানদের বার্ষিক এই বৃহত্তম সম্মেলনে, সেখানে বিদেশ থেকে অল্প কয়েকজনকে প্রতীকী হিসেবেও অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে এবারের হজ হলেও আমরা দোয়া করব মহান আল্লাহ পরিস্থিতিতে যেন স্বাভাবিক করে দেন। আগামী বছর থেকে যেন মুসলিম উম্মাহ স্বাভাবিক হজ আদায় করতে পারে।
লেখক ও গবেষক; অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন