- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- সাহেদ একটি সর্বনাম
সাহেদ একটি সর্বনাম
বাংলা ব্যাকরণের নিয়ম বিস্মৃত হয়ে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভের শিরোনামে প্রতারক সাহেদকে আমরা 'সর্বনাম' বলছি, এমন নয়। অবশ্য চারদিকে যেভাবে সর্বগ্রাসী অনিয়মেরই বাড়বাড়ন্ত, তাতে নিয়ম ভুলে যাওয়া আজকাল কতটা দোষের তা বিবেচনার বিষয়। একজন মো. সাহেদ বা সাহেদ করিমই যেভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংবাদমাধ্যম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলকে বছরের পর বছর ঘোল খাওয়াতে পেরেছেন, তাতেই প্রমাণ হয় দুর্নীতি ও প্রতারণা কতটা সুলভ। কিন্তু তার মতো 'খ্যাতিমান' বিশেষ্যকে আমরা সর্বনাম আখ্যা দিচ্ছি এই প্রতারণা বৈচিত্র্যের কারণে, তাও নয়। এর মধ্য দিয়ে আমরা আসলে বলতে চাইছি, আমাদের চারপাশেই আরও অনেক সাহেদ ভিন্ন ভিন্ন নামে ও চেহারায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতারণার অন্যান্য প্রসঙ্গে পরে আসা যেতে পারে। করোনা পরিস্থিতিতে উন্নত, অনুন্নত দেশ নির্বিশেষে মানব জাতি যখন অসহায়, তখন কভিড-১৯ পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিয়ে কি সাহেদ কেবল একাই অনিয়ম ও প্রতারণা করেছে? আমরা দেখছি, রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে দৃশ্যত যোগাযোগ না থাকলেও একই ধারার অপর একটি 'প্রতিষ্ঠান' জেকেজি একই ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। তারাও রিজেন্ট হাসপাতালের মতো অসহায় ও আতঙ্কিত নাগরিকের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে নমুনা সংগ্রহ করেছে এবং সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই কভিড-১৯ নেগেটিভ বা পজিটিভ ফলাফল দিয়েছে।
ভুঁইফোঁড় ওই প্রতিষ্ঠানের 'চেয়ারম্যান' ছিলেন এমন একজন নারী, যিনি একটি শীর্ষস্থানীয় সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের চিকিৎসক। সংবাদমাধ্যমে নাগরিকদের চিকিৎসাবিষয়ক পরামর্শও দিতেন। তার সহযোগী হিসেবে প্রতারণার জাল বিস্তারে ভূমিকা রেখেছেন আরও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি। সাহেদের যে দুই হাসপাতাল চিকিৎসার নামে অনিয়ম ও প্রতারণা করেছে, সেখানেও জড়িত ছিলেন সত্যিকারের কিছু চিকিৎসক। এই অভিযোগও নাগরিকদের কাছ থেকে কম আসেনি যে, বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নতুন এই রোগের নমুনা সংগ্রহ বা চিকিৎসার নামে বহুমাত্রিক প্রতারণা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে আরও কিছু নাম জানা বা না জানা 'স্বাস্থ্যসেবা' প্রতিষ্ঠান। বলা বাহুল্য, এসব কাজে সাধারণ মানুষ বা ছিঁচকে অপরাধী কমই যুক্ত হয়েছে। বরং প্রতারণা করেছে কথিত শিক্ষিত ও চৌকশ কিছু ব্যক্তি। আমাদের প্রশ্ন, এরা প্রত্যেকেই কি একেকজন সাহেদ নয়? সাহেদের যে 'রূপকথার মতো' উত্থানের গল্প এখন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে, তা কি তিনি একা একাই সম্ভব করতে পেরেছেন? অস্বীকার করা যাবে না যে, মূল প্রতারক হিসেবে সাহেদই সর্বোচ্চ দোষী এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রমরমা এই যুগে কার সঙ্গে কার সামাজিকতা তৈরি হয়, তা বলা মুশকিল। কিন্তু সাহেদকে সাবই অজ্ঞানে প্রশ্রয় দিয়েছে, সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরেছে- এমন নয়। বরং এর নেপথ্যে অন্যায় সুবিধা নেওয়ার যে সন্দেহ জনপরিসরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা অমূলক হতে পারে না। অনেক নাটক করে সাহেদ শেষ পর্যন্ত আটক হয়েছে, এটা স্বস্তিদায়ক। কিন্তু তার যারা মদদদাতা, তাদেরও যদি চিহ্নিত করা না যায়, তাহলে দেশের বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান সাহদদের কারও কারও আরও বড় সাহেদ হয়ে ওঠার সুযোগ থেকেই যাবে। আগেও এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা সংবাদমাধ্যমের প্রতি আত্মজিজ্ঞাসার আহ্বান জানিয়েছিলাম। এবারও তার পুনরাবৃত্তি করি। কারা এভাবে গোটা সংবাদমাধ্যমের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা বিকিয়ে দিচ্ছে অন্তত চিহ্নিত হওয়া জরুরি। আমরা দেখেছি, সামাজিক যোগাযোগ ও যূথবদ্ধতা ব্যবহার করে সাহেদ পৌঁছে গিয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের একটি কমিটিতে। এমনকি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও পৌঁছতে পেরেছিল নির্বিঘ্নে। একজন এতবড় প্রতারকের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকতার স্থানে পৌঁছে যাওয়া সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্যও নিঃসন্দেহে বড় হুমকি। এক সাহেদ ধরা পড়েছে; অন্য সাহেদরা যদি বাইরে থেকে যায়, তাহলে সেই হুমকি থেকেই যাবে।
মন্তব্য করুন