সফল ব্যবসায়ীর কথা উঠলেই সমসাময়িককালে আমরা মুকেশ আম্বানি, লক্ষ্মী মিত্তাল বা জ্যাক মার দিকে তাকাই। নতুন নতুন ব্যবসার দুয়ার খুলে তারা যেমন হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন, তেমনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারেও দিয়ে যাচ্ছেন অর্থ। সমাজের বিপদ-আপদেও ছায়া হয়ে দাঁড়ান তারা।

আমাদের দেশেও সফল শিল্পোদ্যোক্তা অনেকে সোনালি স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। এমন এক স্বাপ্নিক মানুষ ছিলেন যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল। তিনি সাহসী, পরিশ্রমী, নিবেদিত দেশপ্রেমী এক শিল্পোদ্যোক্তা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের যে ক'জন ব্যবসায়ী নিজ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের শিল্পায়ন চিত্র পাল্টে দিয়েছেন, তাদের অন্যতম তিনি।

১৪ জুন অনেকটা নীরবে-নিভৃতেই চলে গেলেন নুরুল ইসলাম বাবুল। তার হাতে গড়া সক্রিয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪১টি। একেবারে শূন্য থেকে ৭৪ বছরের জীবনে এতগুলো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা চাট্টিখানা কথা নয়। অথচ একজন নুরুল ইসলাম বাবুল উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুই হাতে পাননি। সবকিছুই করেছেন তিনি তিল তিল করে, নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে। ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে শুরু করে বিপণন- সবই করেছেন তিনি। একের পর এক গার্মেন্ট, রাসায়নিক, চামড়া, ইলেকট্রনিক্স, ক্রাউন বেভারেজ, নিটিং, মিডিয়া, মোটরগাড়ি, টয়লেট্রিজ মূলত এসব খাতকে সামনে রেখেই তিনি বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

এই শিল্পোদ্যোক্তার হাতেই গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন বৃহৎ এক শপিংমল 'যমুনা ফিউচার পার্ক'। এই শপিংমলটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় শপিংমল হিসেবে পরিচিত। এ রকম জনঘনিষ্ঠ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছেন। তার মধ্যে দৈনিক যুগান্তর এবং যমুনা টেলিভিশনও রয়েছে। মিডিয়া জগতে এ দুটি প্রতিষ্ঠান আস্থার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

আগেই বলেছি একজন নুরুল ইসলাম বাবুল উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুই পাননি। শুধু জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে কাজে লাগিয়ে তাকে সফলতা ধরতে হয়েছে। তবে মনের ভেতর তিনি যে বরাবরই বড় এক স্বপ্ন পুষে রাখতেন সেটি প্রমাণ করে গেছেন। এ কারণেই বহুমুখী শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করে নানান কর্মসংস্থানের পথ উন্মুক্ত করেছেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি কিছু বিশ্বাস ও নৈতিকতাকে মান্য করতেন। সেই নৈতিকতার উল্লেখযোগ্য একটি হলো, খেলাপি সংস্কৃতিকে বর্জন করা। এ কারণে তিনি সরকারের নিয়ম অনুসরণ করেই ব্যাংকের ধারদেনা পরিশোধ করতেন। তার মৃত্যুর পর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদসহ ব্যাংকিং সেক্টরের বোদ্ধারা অনেকেই মন্তব্য করেছেন- তিনি খেলাপি সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। ব্যাংক থেকে তিনি যে অর্থ নিতেন তা সঠিক সময়ে পরিশোধ করার অনন্য উদাহরণ তার রয়েছে। দেশের টাকা তিনি দেশেই রেখেছেন। বিত্তবানদের মাঝে বিদেশে সেকেন্ড হোম করার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সেই কালিমা এই মানুষটিকে স্পর্শ করতে পারেনি।

শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যই করেননি, দুঃসময়েও নুরুল ইসলাম বাবুল রাষ্ট্র ও জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। করোনাদুর্যোগ শুরুর পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে স্বতঃস্টম্ফূর্তভাবে ১০ কোটি টাকা প্রদান করেন। শুনেছি একটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল করার ইচ্ছা ছিল তার। সেটি শুরু করে যেতে পারেননি। তার যোগ্য উত্তরাধিকাররা সেটি করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি। বস্তুত শ্রদ্ধেয় নুরুল ইসলাম বাবুলের প্রয়াণের পর তার উত্তরাধিকারদের দায়দায়িত্ব অনেক। তাদের অভিভাবক যে সাজানো সংসার রেখে গেলেন, তা আরও শোভিত ও সুসজ্জিত করার দায়িত্ব তাদেরই।

আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো কর্মসংস্থানের অভাব। দেশে প্রচুর জনশক্তি থাকলেও সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। এ কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ তরুণকে রেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। একজন নুরুল ইসলাম বাবুল সেই বেকারত্ব মোচনেই নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। অবশ্যই সে পথে তিনি একজন সফল নায়ক। দেশীয় ব্যবসা ও শিল্প জগতে তিনি একটি ইতিহাস, একটি অনুপ্রেরণা। তিনি আমাদের দেশের মুকেশ আম্বানি বা লক্ষ্মী মিত্তাল বা জ্যাক মা।

চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
Kirondebate@gmail.com