
করোনা অবশ্যই একসময় পরাজিত হবে, তবে মানবসমাজ আর আগের মতো থাকবে না। করোনা থেকে যদি মানুষ শেখে- মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই। কেননা করোনা যাকে পায় তাকেই ধরে, সে ধনী হোক, ক্ষমতাবান হোক আর গরিব হোক- সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। এ অবস্থায় মানুষ যদি মানবিক-সামাজিক মূল্যবোধে দীক্ষিত হয় এবং ধান্দাবাজি ত্যাগ করে 'প্রত্যেকে মোরা পরের তরে'- মানবতার এই তাগিদ গ্রহণ ও অনুসরণ করে, তাহলে এই পৃথিবী সুন্দর হবে; মানবজীবন সবার জন্য ধন্য হবে এবং বাস্তবে রূপ নেবে- 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।' আর বাংলাদেশ গড়ে উঠবে সব নাগরিকের সম-অধিকার ও সম-সুযোগের বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায়।
মনে রাখা দরকার, নতুন এ করোনাভাইরাস এমন এক অদৃশ্য শত্রু যার বিরুদ্ধে সবাইকে লড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে যেমন ব্যক্তি সচেতনতা জরুরি, তেমনি জীবন ও জীবিকার বিষয়টিও এড়ানোর সুযোগ নেই।
করোনা মহামারিতে কমে গেছে মানুষের আয়। এর ফলে বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। ইতোমধ্যে আট লাখ প্রবাসী দেশে ফিরেছে, দেশেও লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এ বিষয়টিও সরকারকে মাথায় রাখতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে সব মিলিয়ে ২৭ লাখ বেকার রয়েছে। করোনায় এই বেকারত্ব আরও বাড়বে। বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কীভাবে করা যায় সেদিকে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কারণ গার্মেন্ট ও রেমিট্যান্স পরিস্থিতি ভালো নয়। দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ার পেছনে এই দুটি খাত প্রভাব ফেলবে।
পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র থেকে দারিদ্র্য দূর হোক- এটাই আমরা চাই। আমরা এও চাই করোনাকালে দেশ যাতে অর্থনৈতিক মন্দার কবলে না পড়ে। তবে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে না পারলে দারিদ্র্য পুরোপুরি দূর করা সম্ভব নয়। দূর করা সম্ভব নয় অর্থনৈতিক মন্দাও। কারণ করোনাকালেও দুর্নীতি থেমে নেই। জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণের চাল ও তেল চুরি করেছেন। প্রায় ১০০ জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হয়েছেন। চারদিকে ভুয়া বিলের ছড়াছড়ির খবর। এসব কারণে আমাদের যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, প্রচুর থাকা সত্ত্বেও আমরা সে অবস্থায় এখনও যেতে পারিনি। এসব বাধা দূর করতে পারলে অর্থনৈতিক মন্দাসহ দারিদ্র্য আশানুরূপ হ্রাস করা সম্ভব। সম্ভব পর্যায়ক্রমে মধ্যম আয়ের ও উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাও। তবে করোনার জন্য বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে তার প্রভাব যে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে পড়বে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। সুতরাং আমাদের সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। অর্জন করতে হবে অর্থনৈতিক সক্ষমতা।
কভিড-১৯-কে বিবেচনায় নিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে হলে জনগণের হাতে অর্থ যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এ জন্য উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ জন্য যেসব প্রকল্প কম গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো বাদ দিতে হবে। আর মেগা প্রকল্পের মধ্যেও যেগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো এখন স্থগিত রেখে অন্যদিকে মনোযোগ দিতে হবে। এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো মানুষকে কাজ দিতে হবে। খাবার দিতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ দিতে হবে।
বর্তমান করোনা মহামারির বাস্তবতায় সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতের তালিকায় পুঁজিবাজারকেও অন্তর্ভুক্ত করা অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই অতি জরুরি। বেশির ভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরেই খেলাপি ঋণের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। মহামারির প্রভাবে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্প- পোশাক খাত চাপের মুখে পড়ায় আগামী দিনগুলোয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়বে বৈ কমবে না। ফলে নতুন ঋণপ্রবাহ আরও সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পথ বাধাগ্রস্ত হবে বিবেচনায় নিলে শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে সরকারের জন্য। ফলে নতুন করে শিক্ষিত তরুণের একটি বড় অংশ কর্মহীন থাকার আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নেবে, যা সামাজিক স্থিতাবস্থার জন্য হয়ে উঠতে পারে হুমকিস্বরূপ।
বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পের অনেক কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ অবস্থায় এসব প্রকল্প থেকে অর্থ বরাদ্দ একেবারে সরিয়ে নেওয়া বাস্তবসম্মত নয়, কারণ এর মধ্য দিয়ে প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে; যা অর্থনীতিতে ভিন্ন মাত্রার সুদূরপ্রসারী ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই রেশনিং ব্যবস্থার মতো করে হলেও সিংহভাগ শেষ হয়ে যাওয়া প্রকল্পে সরকারের অর্থায়ন অব্যাহত রাখার বাইরে কোনো বিকল্প নেই। শিল্প খাত টিকিয়ে রাখার জন্য এ খাতে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ যেমন অব্যাহত রাখতে হবে, পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধিসহ গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প ও কৃষি খাতে সরকারের সরাসরি প্রণোদনা গুরুত্বপূর্ণ।
চেয়ারম্যান, এলবিয়ন গ্রুপ
বিষয় : জীবন-জীবিকা রাইসুল উদ্দিন সৈকত
মন্তব্য করুন