সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ডা. সাবরিনার নানা ভঙ্গিমার ছবিতে সয়লাব। সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ দু'জনে মিলেই করোনার সনদ জালিয়াতি করেছেন। এখানে সাবরিনা ও আরিফের দুর্নীতি, অনিয়ম ও জালিয়াতির সংবাদ প্রচার করা যেতে পারে। তবে আরিফের ছবি তেমনভাবে প্রচার হচ্ছে না। শুধু সাবরিনার ছবি গণহারে প্রচার সামাজের পুরুষতান্ত্রিক আচরণকে ব্যাখ্যা করে। যারা প্রচার করছেন তাদের বেশিরভাগই পুরুষ। হতে পারে তিনি উচ্চশিক্ষিত ও সুশ্রী। তিনি হয়তো দুর্নীতির মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নিতে নিজের সৌন্দর্যকে ব্যবহারও করতে পারেন। কিন্তু তার ব্যক্তিগত ছবির গণপ্রচার কখনোই কাম্য হতে পারে না। অনেকেই এই প্রচার-প্রচারণাকে পুরুষতান্ত্রিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন। একধরনের অবদমন ও কামনা থেকে সাবরিনার ছবি প্রচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগও উঠেছে। এই অভিযোগকারীর বড় একটি অংশই নারীবাদী। নারীবাদীরাও সমালোচনার বাইরে নন। সাবরিনার ঘটনায় ঝাঁপিয়ে পড়লেও বেশিরভাগই বিস্ময়করভাবে নীরব ছিল সাজিদা ইসলাম পারুলের ক্ষেত্রে।

পারুলের কথা আপনাদের অনেকেরই মনে আছে। আমি সংবাদমাধ্যমে তার ছবি দেখেছি। প্রতারণার বিচার চেয়ে একটি বড় সাদা কাগজে 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমি কি বিচার পাব না' লিখে একাই দাঁড়িয়ে ছিলেন পারুল। পারুল নিজেও একজন সংবাদমাধ্যম কর্মী। তার পাশে অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমের কর্মী বা নারীবাদীদের অবস্থান তেমন চোখে পড়েনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েকজন পারুলের পক্ষাবলম্বন করে পোস্ট দিয়েছিলেন বটে; প্রতিবাদী দলটা খুব বেশি ভারি হয়নি। পারুল এখন আর আলোচনায় নেই। এই ফাঁকে পারুলের অভিযোগটি আগে বলে নিই। পারুল ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সংবাদমাধ্যমেরই আরেক কর্মী রেজাউল করিম প্লাবনকে। কিন্তু বিয়ের পর প্লাবন পারুলকে নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হননি, গোপনে আরও একটি বিয়ের উদ্যোগ নেন। এটা জানতে পেরে পারুল করোনা দুর্যোগের মধ্যেই উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রামে পল্গাবনের গ্রামের বাড়িতে ছুটে যান এবং বিয়ে আটকাতে সমর্থ হন। পারুলের উত্তরবঙ্গ যাত্রার ঘটনাটি আমি পড়েছি। অধিকারের লড়াইয়ে একজন নারীর ভয়ংকর একাকী যাত্রা। ঢাকায়ও গলায় পল্গ্যাকার্ড ঝুলিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন পারুল। তবে দু-একজন ছাড়া কাউকে তিনি সঙ্গী হিসেবে পাননি।

ডা. সাবরিনা ও পারুলের ঘটনা দিয়ে দেশের নারীবাদী আচরণ অনুধাবন ও ব্যাখ্যা করা যায়। এখানে নারীবাদ যেন অভিজাততন্ত্র সমর্থন ও অনুসরণ করে। কোন ঘটনার প্রতিবাদ করতে হবে, আলোচনায় আনতে হবে- এক্ষেত্রে ভিকটিমের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচ্য হয় অনেক সময়। ডা. সাবরিনা একসময় নায়িকা হতে চেয়েছিলেন। তিনি নায়িকা হতে না পেরে চিকিৎসক হয়েছেন। তবে তার জীবনে গ্ল্যামারের ছাপ স্পষ্ট ছিল। চলন, বলন, পোশাকে তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা। তিনি ক্ষমতার কাছাকাছি গিয়েছিলেন। বিভিন্নভাবে ক্ষমতার ব্যবহারও করেছেন। তার কৃতকর্মকে এড়িয়ে একদল তার ছবি প্রচারে ব্যস্ত। যেন তার সৌন্দর্য বা পোশাক ও আচরণের কারণেই তিনি দুর্নীতিবাজ হয়েছেন। তবে ভিন্ন মতও আছে। খোলামেলা পোশাক বা সৌন্দর্যকে পুঁজি করেও অনেকে নানা সুবিধা আদায় করে থাকেন। রক্ষণশীল পোশাকের কেউ যে দুর্নীতি করেন না এমনও নয়। তবে পোশাককে এককভাবে দুর্নীতি, জালিয়াতির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা মুশকিল। বরং পোশাকের পাশাপাশি ব্যক্তি আচরণের দায়কে এখানে আলোচনায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।

সাবরিনার ছবি গণহারে প্রচারে অপরাধকে মুখ্য না করে নারীকে মুখ্য করা হয়েছে। এমনটাই অভিযোগ করছেন নারীবাদীরা। এ জন্য অবশ্যই তারা সাধুবাদ পাবেন। সাবরিনার ছবি প্রচারের বিপক্ষেই থাকবেন সমাজের অধিকাংশ মানুষ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সাবরিনার ছবি প্রচারের ক্ষেত্রে নারীবাদীরা যতটা সক্রিয়, পারুলের ক্ষেত্রে ততটা নয় কেন। সাবরিনা একজন অপরাধী। নারীবাদীদের যুক্তি হচ্ছে- অপরাধটাই মুখ্য অপরাধীর পোশাক নয়। কিন্তু স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে পোশাকের ব্যবহার খুব একটা অবিবেচ্য নয়। এটা নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অন্যদিকে পারুল অপরাধী নন। তিনি ঘটনার শিকার। তার পক্ষে নারীবাদীদের শক্ত করে নামা দরকার ছিল। পারুল যে অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন, এ ধরনের ঘটনার শিকার আমাদের নারীরা হরহামেশাই হন। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের নারীদের লড়াই দীর্ঘদিনের। নারীবাদীরা কখনও কখনও এসবের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছেন বটে কিন্তু তাদের শ্রেণি চেতনা প্রবল।

পারুল মফস্বলের সাধারণ ঘরের মেয়ে। সাবরিনার বাবা সরকারের সচিব ছিলেন। ক্ষমতার অন্দরমহলে তার ভালো যোগাযোগ ছিল বলে সংবাদমাধ্যমে তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। তাই সাবরিনার নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার মানুষের অভাব নেই। পারুলের কপোলে কড়া মেকআপের বদলে থাকে পরিশ্রমী ঘামের বিন্দু। অন্যদিকে সাবরিনা ঝা চকচকে গাড়িতে করে হাসপাতালে যান। বেসরকারি টেলিভিশনে করোনা নিয়ে পরামর্শ দেন। সাজ-পোশাকে তিনি সমাজের অভিজাততন্ত্রের প্রতীক। তাই পারুল নারীবাদীদের ততটা আকৃষ্ট করতে পারেন না সাবরিনা যতটা পারেন পুরুষতন্ত্র ও নারীবাদ উভয়কে। এখানে যেন উভয় পক্ষের বিষ্ফ্ময়কর মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

বাস্তবতা হচ্ছে, যে ধারণা, ভাবনা ও চিন্তার জায়গা থেকে পশ্চিমে নারীবাদের বিকাশ ঘটেছিল, আমাদের সেখানে পৌঁছতে আরও অনেক সময় লেগে যাবে। পশ্চিমে এখন নারীবাদের চতুর্থ ধাপ চলছে। আর আমাদের নারীবাদ এখনও যেন প্রথম ধাপেই। পশ্চিমে নারীবাদের প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল ১৮৪০ সালের দিকে। নারীবাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল নারীর সামাজিক, নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থান ও অধিকারের দাবিতে। এর আগে শ্রেণি চেতনাকে চিন্তা থেকে বিলুপ্ত করতে হয়েছিল। শ্রেণি চেতনাকে পায়ে দলেই নারীর অন্যান্য অধিকার নিয়ে অগ্রসর হন নারীবাদীরা। আমাদের নারীবাদীরা কি এখনও শ্রেণি চেতনা থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন?

রাজনৈতিক বিশ্নেষক