- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- দুবাইয়ে পাচার হওয়া দুঃখিনী নারী
সমকালীন প্রসঙ্গ
দুবাইয়ে পাচার হওয়া দুঃখিনী নারী

মানব ও অর্থ পাচার মামলায় সম্প্রতি আমাদের সংসদ সদস্য শহীদ ইসলাম পাপলু কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়া নিয়ে যখন তোলপাড় চলছে, এমনকি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পর্যন্ত এ নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা যখন হয়েছে, তখন দুবাইয়ে নারী পাচারকারী আজম খানের গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের ফের আরেকটি কালো অধ্যায়ের উন্মোচন করেছে। সমকালসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে আজম খান ও তার সহযোগীরা চাকরির প্রলোভনে দুবাইয়ে সহস্রাধিক তরুণীকে পাচার করে কীভাবে যৌনকর্মে বাধ্য করেছে। আজম খানদের সৃষ্টি এক দিনে হয়নি। আজম খান ও শহীদ ইসলাম পাপলুর সংখ্যা কম নয়, তাও অতীতে সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছিল।
আমাদের দেশের অনেক জীবন মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ার কারণে ইতোমধ্যে নির্মম পরিণতির বেদনাদায়ক অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে নারী-শিশুর সংখ্যাও কম নয়। উদ্বেগজনক বিষয় হলো- শুধু নারীরা পাচার হচ্ছেন তা-ই নয়, পাচারকারী চক্রের সঙ্গে নারী সদস্যরাও যুক্ত আছেন। আজম খানের নেতৃত্বে গঠিত চক্রের শিকড় কতটা গভীরে প্রোথিত তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত সংবাদেই অনেকটা অনুমান করা যায়। মানব পাচারকারীদের কারণে আমাদের আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বিরূপ প্রভাব পড়ার অনেক দৃষ্টান্তও আমাদের সামনে আছে। এক একটি ঘটনা উন্মোচিত হয়, সংবাদমাধ্যমে হৈচৈ পড়ে এবং প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা শুরু করেন দৌড়ঝাঁপ। তারপর একপর্যায়ে আবার সব চুপচাপ হয়ে যায়। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম কম হয়নি। কিন্তু সুফল মেলেনি।
সংবাদমাধ্যমে আজম খানকে নারী পাচারকারী চক্রের গডফাদার বলা হয়েছে। তার খপ্পরে পড়া তরুণীরা তার কথামতো না চললে কীভাবে তাদের ওপর নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসত তাও সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে। চট্টগ্রামের বাসিন্দা এই আজম খান টর্চার সেলে আটকে রেখে বহুমুখী নির্যাতন চালাত তাদের ওপর। ১৩ জুলাই সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুবাইয়ে হোটেল ব্যবসার আড়ালে যৌন ব্যবসাই ছিল তার প্রধান। দেশে তার অর্ধশতাধিক দালাল সক্রিয় রয়েছে- এও বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। তাদের মাধ্যমে হোটেলে বেশি বেতনে চাকরির প্রলোভনে তরুণীদের দুবাইয়ে পাচার করা হতো। এই আজম খানদের বসবাস বটবৃক্ষের ছায়াতলে- এমন অভিযোগও নতুন নয়।
সভ্যতা-মানবতাবিরোধী এই অপকর্মের হোতাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হলেও আমাদের সামনে দৃষ্টান্তযোগ্য বিচারের নজির বিরল। আমি মনে করি বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির কারণেই আজম খানরা এমন জঘন্যতম অপরাধের জাল বিস্তৃতকরণের সুযোগ পেয়েছে কিংবা পাচ্ছে। সম্প্রতি করোনা দুর্যোগেও লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার মর্মস্পর্শী ঘটনা ফের প্রমাণ করে দিয়েছে মানব পাচারের মতো ভয়াবহ অপরাধের শিকড় এদেশে কতটা গভীরে প্রোথিত। একদিকে রাতারাতি জীবনযাপনের চিত্র পাল্টে ফেলার স্বপ্ন, অন্যদিকে অসচেতনতাসহ নানারকম পরিস্থিতিও মানব পাচারকারীদের জন্য মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের পথ প্রশস্ত করে দেয়। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ- মানব পাচারের জন্য যে মামলা দেশে হয় বা হয়েছে তা প্রকৃত অপরাধের তুলনায় খুবই কম।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরেই জেনেছি, মানব পাচার সংক্রান্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি। এও জেনেছি, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে মাত্র চারজন অপরাধীর সাজা হয়েছে। এই যদি হয় পরিস্থিতি, তাহলে দেশে কিংবা সমাজে মানব পাচারের অভয়ারণ্য হওয়ার সুযোগটা আরও বেড়ে যায় সঙ্গত কারণেই। অবৈধ অভিবাসন বন্ধ, শ্রমশক্তি রপ্তানিতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, মানব পাচারকারীদের উৎস সন্ধানক্রমে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় দ্রুত বিচার ইত্যাদি জনদাবি নতুন নয়। কিন্তু এসব কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ও উদাসীনতা কিংবা কখনও কখনও সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল অসাধুদের সঙ্গে অপরাধী চক্রের যোগসাজশের যে অভিযোগ ওঠে, তা আরও বেশি উদ্বেগের।
গত জুন মাসে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে মানব পাচার রোধে বাংলাদেশের এক ধাপ উন্নতির খবর জেনেছিলাম। সংবাদটি আশাব্যঞ্জক ছিল নিঃসন্দেহে। ওই প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ মানব পাচার নির্মূলে নূ্যনতম মান পূরণ করতে না পারলেও সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। তাও ছিল আমাদের প্রেক্ষাপটে আশাব্যঞ্জক খবর। কিন্তু এমন আশাব্যঞ্জক খবরের পর কিছুদিন যেতে না যেতেই দুবাইয়ে নারী পাচারের যে শক্তিশালী চক্রের সন্ধান মিলল তাতে উদ্বেগ-হতাশা দুই-ই বেড়েছে। অপরাধ দমনে বর্তমান সরকারের সাফল্যের বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তার পরও দুবাইয়ে নারী পাচারের যে ঘটনা উন্মোচিত হলো তাতে অনেক প্রশ্নেরই জন্ম দেয়। দুবাইয়ে নারী পাচারকারী চক্রের অন্য সদস্যদের আত্মগোপনে থাকার খবরও সংবাদ মাধ্যমে এসেছে।
নারী পাচারকারী চক্রের মূল হোতা আজম খানের কমিশনভোগী দালাল হিসেবে দেশে-বিদেশে যারা কাজ করছে, তাদের খুঁজে বের করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জরুরি কর্তব্য। বিদেশে যারা আত্মগোপনে আছে তাদের পাকড়াও করতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে যাদের পাচার করা হয়েছে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থাও ত্বরিত নিতে হবে। মানব পাচার রোধে একাধিক আইন ও বিভাগীয় শহরে বিশেষ আদালত থাকা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে কেন অন্ধকারের বিস্তৃতি ঘটছে এ প্রশ্ন থেকেই যায়। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি দেশ-সমাজে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, অতীত থেকে এমন অনেক দৃষ্টান্তই দেওয়া যাবে। কাজেই এ ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলদের দায়দায়িত্ব উচ্চারণ-সর্বস্ব অঙ্গীকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কাজের কাজটুকু করতেই হবে।
এ ব্যাপারে যেমন সার্বিক নজরদারি বাড়াতে হবে, তেমনি দৃষ্টান্তযোগ্য বিচারও নিশ্চিত করতে হবে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যাতে কেউ পার পেয়ে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করার দায় মামলা সাজানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের। এক আজম খানই যদি সহস্রাধিক নারী পাচার করতে পারে, তাহলে প্রশ্ন জাগে- আর কত নারী এ রকম আরও আজম খানদের হাতে বলি হয়েছেন! এই প্রশ্ন বেদনা এবং একই সঙ্গে উদ্বেগেরও। একটা স্বাধীন দেশের জনগোষ্ঠীর সদস্যরা তো এভাবে নির্মমতার শিকার হতে পারেন না। এক্ষেত্রে যে সচেতনতার অভাব রয়েছে তাও অসত্য নয়। দেশে নারীর কর্মক্ষেত্রের পরিসর বেড়েছে। নানারকম আত্মকর্মসংস্থান গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করেছে সরকার। এই সুযোগ শুধু নারীর জন্য নয়, পুরুষেরও রয়েছে।
এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, নারী পাচারের ক্ষেত্রে নেপালের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। পাচারকারীরা পাচারের জন্য জল-স্থল নানা পথ বেছে নেয় এবং পাচারকালে এমন বিপদসংকুল পথে এ পর্যন্ত প্রাণহানির মতো মর্মন্তুদ ঘটনাও কম ঘটেনি। পাচারকারীরা যেসব রুটকে পাচারের জন্য নিরাপদ মনে করে বেছে নেয়, সেসব রুটে বিশেষ নজর দিতে হবে। রক্তমূল্যে অর্জিত এই দেশটি নারী ও শিশু পাচারের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে আখ্যায়িত হবে, তা তো হতে পারে না। একে তো নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে বিভিন্ন দেশে আর এরা সেসব দেশে অত্যন্ত অমানবিক জীবনযাপন করছেন। এই অন্ধকার ঘোচাতে হবে। এক্ষেত্রে যেমন বাড়াতে হবে জনসচেতনতা, তেমনি আইন প্রয়োগের পথও করতে হবে মসৃণ।
এও উল্লেখ্য, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সরকারিভাবে গমনকারী অনেক নারীর পরিণতিও সুখের নয়। এরা নানাভাবে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সংবাদমাধ্যমে বৈধভাবে বিদেশে কর্মরত নারীদের নির্যাতনের নানা চিত্রও নিকট অতীতে উঠে এসেছিল। নারী ও শিশু নির্যাতনের মধ্যে অন্যতম হলো পাচার। পাচারকারীরা সভ্যতা-মানবতার শত্রু। এদের আইনানুগ দৃষ্টান্তযোগ্য দণ্ডই ঘোচাতে পারে অন্ধকার। মানব পাচার একটি জঘন্যতম অপরাধ। আজম খানরা এত বড় অপরাধ এতদিন কীভাবে করে এলো তাও খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ ব্যাপারে কোনো রকম কালক্ষেপণ কাম্য নয়। সমাজের এই দুষ্টক্ষত সারাতে সমাজের সচেতন মানুষদেরও সরকার এবং প্রশাসনকে যথাযথ সহযোগিতা করা দরকার। সম্মিলিত প্রয়াসেই কাটাতে হবে আঁধার।
কথাসাহিত্যিক
মন্তব্য করুন