আমরা দেখছি, করোনাদুর্যোগের অর্থনৈতিক প্রভাবে দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। শহরে জীবন-জীবিকার পথ সংকুচিত হওয়ার কারণে উল্লেখযোগ্য মানুষ বাধ্য হয়ে গ্রামমুখী হচ্ছেন। রোববার সমকালে প্রকাশ- শ্রমবাজারের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনায় কর্মসংস্থান কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকারের প্রণোদনায় কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর আয়োজনে আলোচনার মূল বিষয় হয়ে ওঠে শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থান। এই মহামারিকালে আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ কম নয়। একদিকে যেমন করোনার সংক্রমণ ঠেকানো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অন্যদিকে কর্মসংস্থান ও জীবিকা একই সঙ্গে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার পাশাপাশি কর্মহীনদের কর্মে যুক্ত করাও জরুরি। বৃহত্তর পরিসরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিস্তৃতকরণের পাশাপাশি জোর দিতে হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতি। এই বাস্তবতায় কর্মসংস্থান কমিশন গঠনের প্রস্তাব আমরা অত্যন্ত সময়োপযোগী বলেই মনে করি।

অনস্বীকার্য যে, বৃত্তিমূলক চাকরি ও কারিগরি বা কর্মের চাহিদা ক্রমেই বাড়লেও আমাদের বাস্তব চিত্র এর বিপরীত। শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত প্রায় সবাই নগরে-শহরে এসে চাকরির জন্য ভিড় জমান। কিন্তু করোনাদুর্যোগ প্রেক্ষাপট ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে বলে মানুষ ফিরছেন গ্রামে। একই সঙ্গে অনেক শ্রমিক ইতোমধ্যে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। আবার অনেকে আসার সুযোগ খুঁজছেন। আমাদের বড় আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার সৌদি আরবসহ মধ্যেপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রস্তুতির খবর ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এমনিতেই দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা কম নয়। এর মধ্যে প্রবাসীদের বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসায় কিংবা আসার প্রেক্ষাপট তৈরি হওয়ায় নতুন করে সঙ্গতই অধিকতর চাপ সৃষ্টি হবে। যদি স্বল্প সময়ের মধ্যে করোনা পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত ভালো কিংবা স্বাভাবিকও হয়, তবুও অর্থনৈতিক ধকল সহজে কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে বলে মনে হয় না।

আমরা জানি, কৃষিসহ নানারকম আত্ম-কর্মসংস্থান কর্মসূচি বাস্তবায়নের সুযোগ রয়েছে গ্রামে। আমাদের বাস্তবতায় গ্রামকেন্দ্রিক নতুন অর্থনৈতিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও এর বাস্তবায়নের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যদি এক্ষেত্রে দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের ভিত্তিতে বাস্তবায়নের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া যায়, তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পথ মসৃণ হতে পারে। বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদ ও উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার দেশে বেকারত্ব নতুন নয়। তবে করোনাদুর্যোগ এক্ষেত্রে বড় রকমের বাড়তি উপসর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য, অনেক উন্নত দেশেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে পাশাপাশি এ কথাও সত্য, বাংলাদেশে এমন অনেক জীবিকা পাওয়া যাবে, যা উন্নত কিংবা অনেক উন্নয়নশীল দেশেও 'কর্ম' হিসেবে স্বীকৃত নয়। আবার কর্মের ধারণার মধ্যেও রয়েছে তফাত। দেশে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ যথেষ্টই সৃষ্টি হয়েছিল। তবে বিদ্যমান করোনা বাস্তবতা এক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।

কর্মসংস্থানের পরিবেশ নতুন করে সেই নিরিখে গ্রামেই সৃষ্টি করতে হবে। এর জন্য যেমন দরকার দূরদর্শী গঠনমূলক কর্মপরিকল্পনা, তেমনি দরকার এর অন্যতম প্রধান অন্তরায় অনিয়ম-দুর্নীতি দূর করা। জনমিতির বিবেচনায় আমাদের জন্য বড় ইতিবাচক হলো, নাগরিকদের অধিকাংশই তরুণ। তাদের মধ্যে যেমন বাড়ছে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ, তেমনি তারা হয়ে উঠছে প্রযুক্তিমনস্কও। তারা যাতে এই দুর্যোগকালে প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে সহজ শর্তে ঋণসহ সরকারি সবরকম সহযোগিতা পায়, সেদিকে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। প্রবাসফেরতদের নিয়ে নিতে হবে বিশেষ পরিকল্পনা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সরকারি প্রণোদনা যাতে যথাযথভাবে কাজে লাগে এ জন্য ভাঙতে হবে দুষ্টচক্র। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে স্ব-কর্মসংস্থানে অনেকেই এগিয়ে আসবেন বলেও আমরা মনে করি। আমাদের অর্থনীতির আকার ক্রমেই বাড়ছিল। কিন্তু প্রায় বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের যে গাঢ় ছায়া আমাদের এখানেও পড়েছে, এ থেকে উত্তরণে দরকার যথাযথ কর্মপরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন। সব মিলিয়ে কর্মসংস্থান কমিশন বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে গঠন করা জরুরিই বটে। বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারের জন্য বিশেষায়িত নতুন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ওপর জোর দিতে হবে। মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যাপারেও ভাবতে হবে নতুন করে।