বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে দীর্ঘসূত্রতার নজির এদেশে অনেক থাকলেও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বে-নজির হয়ে থাকবে নানা কারণেই। আমরা জানি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দায়িত্বপ্রাপ্তদের ঔদাসীন্য কিংবা মামলা থাকার কারণে বছরের পর বছর চূড়ান্ত নিয়োগ প্রার্থীদের অপেক্ষা করতে হয়। সন্দেহ নেই, তাদের মধ্যে পুরুষের পাশাপাশি নারীও থাকেন। কিন্তু সে জন্য কাউকে মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত থাকার শর্ত পালন করতে হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। মঙ্গলবার সমকালে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে, পরিবার কল্যাণ অধিদপ্তর থেকে আলোচ্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। সেখানে অন্যতম শর্ত ছিল, চাকরিতে যোগদানের সময় কেউ গর্ভবতী থাকতে পারবেন না এবং তিন বছরের কম বয়সী সন্তান থাকতে পারবে না। আমরা মনে করি, এ ধরনের শর্তই অগ্রহণযোগ্য। সন্তান ধারণের স্বাধীনতা নারীর সর্বজনীন অধিকার। দেশে দশকের পর দশক নারী অধিকার আন্দোলনের ফলে মাতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার যখন বেসরকারি পর্যায়েও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে, তখন একটি সরকারি অধিদপ্তরে এমন শর্ত রীতিমতো বিস্ময়কর। নারী অধিকার কর্মী এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী সমকালের কাছে যথার্থই বলেছেন- এমন শর্ত খোদ সরকারের নারী নীতির পরিপন্থি। যেসব নারী এই চাকরি পাওয়ার আশায় গত তিন বছর সন্তান ধারণ থেকে বিরত রয়েছেন, আমরা তাদের অসহায়ত্ব বুঝতে পারি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে চূড়ান্ত তালিকায় যে আড়াই হাজার নারী রয়েছেন, তাদের এক-তৃতীয়াংশ মাত্র নিয়োগ পাবেন। তাহলে বাদ পড়া দুই-তৃতীয়াংশ নারীর কী হবে? এভাবে আড়াই হাজার নারীকে মাতৃত্ব থেকে বিরত রাখা কেবল নিদারুণ অনিয়ম নয়, অমানবিকও বটে। পরিহাসের বিষয়, নারীর জন্য অস্বস্তিকর ও অবমাননাকর এমন একটি সিদ্ধান্ত এসেছে মূলত নারীস্বাস্থ্য নিয়ে কর্মরত পরিবার কল্যাণ অধিদপ্তর থেকে! সন্তান নিতেই যদি বারণ করা হয়, তাহলে পরিবার আসবে কোথা থেকে? পরিকল্পিত পরিবার যেখানে সরকারের নীতি, সেখানে গর্ভধারণ স্থগিত রাখার এমন পরিকল্পনা এসেছে কার উর্বর মস্তিস্ক থেকে? আমরা মনে করি, অবিলম্বে এই শর্ত বাতিল করতে হবে। কেন এমন শর্ত দেওয়া হয়েছিল, করতে হবে সেই জবাবদিহিও। ওই অধিদপ্তরে পুরুষ প্রার্থী নিয়োগের ক্ষেত্রে কি এমন শর্ত কখনও দেওয়া হয়েছিল? সরকার যখন সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছে, তখন একটি অধিদপ্তরের এমন শর্ত সরকারের সেই নীতি ও তৎপরতারই সুস্পষ্ট ব্যত্যয়। একই সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্নও করতে হবে। দেখা যাচ্ছে, নিয়োগ প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার কারণে দৃশ্যত কোনো অনিয়ম ঘটেনি। চূড়ান্ত নিয়োগ প্রদানে সংশ্নিষ্টরা 'আগ্রহ' হারিয়ে ফেলার সেটিও একটি কারণ কিনা খতিয়ে দেখতে বলি আমরা। স্বাস্থ্য খাতে যখন নিয়োগ ও ক্রয় কাজে উৎসাহের ঘাটতি নেই, তখন কোনো দৃশ্যমান কারণ ছাড়া এই নিয়োগ প্রক্রিয়া এতদিন ঝুলে রয়েছে? এর ফলে মাঠ পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত কার্যক্রমে স্পষ্টতই বিঘ্ন ঘটছে। এর জের ধরে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন হয়তো অন্য কোনো নারীই। আবার নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দও ফেরত যাচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য যে কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেছনে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তাও কম নয়। অন্যদিকে একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ না হতেই একই পদে আরেকটি নিয়োগ প্রক্রিয়ার অর্থ কী? আমরা মনে করি, বাড়তি জনবল নিয়োগ দিতে হলে বরং চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য অপেক্ষায় থাকা আড়াই হাজার নারীর মধ্য থেকেই বেছে নেওয়া উচিত। তাতে করে তাদের তিন বছরের অপেক্ষা ও ত্যাগের স্বীকৃতি মিলবে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশও বাববার উপেক্ষিত হচ্ছে বলে আলোচ্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আমরা বলতে চাই, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিশেষের সুবিধা বা খামখেয়ালির কারণে এমন অনিয়ম, অমানবিকতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধ আর চলতে দেওয়া যায় না।

বিষয় : শর্তের জালে মাতৃত্ব

মন্তব্য করুন