প্রশ্ন: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় কখন কোথায় কীভাবে? সে প্রসঙ্গে কিছু বলুন।

উত্তর: ১৯৫৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিলেতের অক্সফোর্ড থেকে বার অ্যাট ল ডিগ্রি করে আমি দেশে ফিরে এলাম। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর (আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট আইনজীবী) রিকমেন্ডেশনে আমি অক্সফোর্ডে গিয়েছিলাম। পরবর্তীকালে জুনিয়র হিসেবে কোর্টে গিয়ে উনার পেছনে বসতাম। সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন ঢাকা আসতেন, তখন আমাদের মুজিব ভাই ও মানিক মিয়া (দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া) বিমানবন্দরে যেতেন তাকে রিসিভ করতে। আমিও যেতাম। কারণ আমাকে অক্সফোর্ডে পড়ার বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এয়ারপোর্টেই মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ঢাকায় এসে মানিক মিয়ার বাসায় থাকতেন। সেখানে মুজিব ভাইও আসতেন। আলাপ-আলোচনা করতেন। সেখানে আমিও যোগ দিতাম। এভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। এখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হতো। মুজিব ভাইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তিনি যা বলতেন তা করতেন। এ জন্য জনগণ তার ওপর আস্থা রাখত।

বঙ্গবন্ধুর কর্মী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সারাজীবনই আমি তার কর্মী ছিলাম। এটা আমার জীবনে বিশাল পাওয়া বলে মনে করি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থেকে তার নির্দেশনায় অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমার ধারণা হলো, তিনি অসাধারণ সাহসী একজন মানুষ। যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই তিনি দেশের জন্য, মানুষের জন্য নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের তরফ থেকে তাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন- আমি মুসলমান। আমার কপালে মৃত্যু যেদিন লেখা আছে, সেদিনই হবে। এটা নিয়ে আমি পরোয়া করি না। হুমকি দিয়ে ভয় দেখিয়ে আমার কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারবে না ওরা (তৎকালীন পাকিস্তানের স্বৈর শাসকরা)। বাংলার মানুষের অধিকারের প্রশ্নে কোনো আপস আমি করব না।

প্রশ্ন: কবে কখন কীভাবে রাজনীতিতে এলেন? জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আপনি রাজনীতিতে আসেন। সে সময়ের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলুন।

উত্তর: অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আমি রাজনীতিতে এসেছি। রাজনীতির শুরুটা ওই সময় (অক্সফোর্ড থেকে ফিরে আসার পর) থেকেই। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ঢাকা এলে উঠতেন মানিক মিয়ার বাসায়। সেখানে মুজিব ভাই আসতেন। আমিও সারাদিন বসে থাকতাম। এটা ছিল আমার জন্য বড় সুযোগ। সেখানে আমাদের মুজিব ভাইয়ের কাছে প্রশ্ন রাখতাম- পাকিস্তানের এই সামরিক শাসন থেকে কীভাবে আমরা মুক্তি পাব? মুজিব ভাই বলতেন, রাতারাতি সামরিক জান্তাকে উৎখাত করা যাবে না। আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। মুজিব ভাইয়ের প্রতি মানুষের অশেষ শ্রদ্ধা ও আস্থা ছিল। কারণ উনি যেটা বলতেন, সেটা করতেন। এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও। বারবার তাকে জেলে নিয়ে গেছে ওরা (স্বৈর শাসকরা)। মিলিটারি কাস্টডিতেও নিয়েছে তারা তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। এই মামলাটা করা হলো যাতে মুজিব ভাই বেল (জামিন) না পান। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় এই মামলায় আমি একজন জুনিয়র ল ইয়ার হিসেবে ছিলাম। যেদিন তিনি জেল থেকে বের হলেন, সেদিনই বলেন, তুমি পার্টিতে (আওয়ামী লীগ) জয়েন করো। আমি বললাম, আমি তো আপনার কর্মী হিসেবে আছি এবং থাকব। এখন ওইভাবে কি পার্টিতে জয়েন করার প্রয়োজন আছে? তখন তিনি বললেন, আমি তো তোমাকে সংবিধান রচনার দায়িত্ব দিতে চাই। সংবিধানের খসড়া তৈরি করে সংসদে সেটা উত্থাপন করতে হবে। সংবিধান নিয়ে সংসদে যে প্রশ্নগুলো আসবে তার জবাব দিতে হবে। ব্যাখ্যা করতে হবে। এসব কাজ করতে হবে বলেই তোমাকে পার্টির মেম্বার হতে হবে। এর পর পার্টির মনোয়ন নিয়ে তোমাকে নির্বাচিত হতে হবে। তখন আমি বললাম, আপনি বললে তো আমার আর কিছু করার নাই। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে রাজনীতিতে আসি।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থেকে তার নির্দেশনায় অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমার ধারণা হলো, তিনি অসাধারণ সাহসী একজন মানুষ। যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই তিনি দেশের জন্য, মানুষের জন্য নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের তরফ থেকে তাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন- আমি মুসলমান। আমার কপালে মৃত্যু যেদিন লেখা আছে, সেদিনই হবে। এটা নিয়ে আমি পরোয়া করি না...

প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধু ও পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়ার মধ্যে বৈঠকগুলোর সঙ্গে আপনিও কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন। ওই বৈঠকগুলোর অজানা বা চমকপ্রদ কোনো স্মৃতিকথা জানাবেন কি?

উত্তর: আমি শেষ দু'একটা বৈঠকে যুক্ত ছিলাম। এটা আমার জন্য বড় সুযোগ ছিল। এসব বৈঠকে থাকতেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আমাকে সেখানে বঙ্গবন্ধু রাখতেন সংবিধানের আইনি বিষয়গুলো দেখার জন্য। সেখানে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যে বক্তব্য রাখতেন সেগুলো আমার দেখার সুযোগ হতো। বাঙালি জাতি জনগণের জন্য যেটা ভালো সেটা তিনি শক্তভাবে তুলে ধরতেন। তিনি আমাদের বলতেন, এখানে আপসের কোনো পথ নেই। ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

ইয়াহিয়া কৌশলে হুমকির ভাষায় কথা বলতেন। সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার (১৯৬৯ সালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনারা তাকে হত্যা করে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি) প্রসঙ্গ তুলে ধরে বৈঠকে ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে বললেন, দেখেন, এখানে তো থমথমে অবস্থা। সার্জেন্ট জহুরুল আপনার কাছে, এখানেই মারা গেছে। আপনি আমার সঙ্গে চলেন রাওয়ালপিন্ডিতে। এয়ার চিফ (তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান) নুর খান আছেন। তিনি নিজেই প্লেনে করে আপনাকে নিয়ে যাবেন। সেখানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আপনি আপনার দাবিগুলো তুলে ধরতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি তো কোনো মামলার আসামি হিসেবে রাওয়ালপিন্ডি যেতে পারি না। প্রথমে তো কেস (মামলা) প্রত্যাহার করতে হবে। শুধু আমার বিরুদ্ধে মামলাই নয়; অন্যদের বিরুদ্ধে মামলাও প্রত্যাহার করতে হবে। বিনা শর্তে প্রত্যাহার করতে হবে এই আগরতলা মামলা। এর পর আমরা পাবলিক মিটিং করব। জনসভা করব। জনগণের সামনে তুলে ধরব আমাদের দাবিগুলো। তাদের সম্মতি নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বৈঠকে যাওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত। তবে এখানে কোনো ছাড় দেওয়ার ব্যাপার নেই। কারণ এটা ছাড়া বাঙালির যে চাহিদা, তা পূরণ হবে না। ৬ দফা অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, আসামি নয়; আমি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে রাওয়ালপিন্ডিতে যাব। আমাকে সেই সম্মান দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, তোমাকেও যেতে হবে রাওয়ালপিন্ডি। কারণ তখন আমি অনেক জুনিয়র ছিলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, এখানে আইন, সংবিধান নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হবে। তোমাকে পাশে থাকতে হবে। তো আমার যাওয়া হলো। আমার মনে আছে, সেদিনের সে আলোচনা ছিল সাজানো। তথাকথিত সে আলোচনা শেষ পর্যন্ত কোনো ফল ছাড়াই ভেঙে গেল।

প্রশ্ন: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম কৌঁসুলি হিসেবে যে ভূমিকা পালন করেছেন, সে বিষয়ে কিছু বলুন।

উত্তর: আমি তখন অত সিনিয়র আইনজীবী ছিলাম না। অনেকের তুলনায় জুনিয়র। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমার ওপর আস্থা রাখতেন, ভরসা রাখতেন। এটা আমার জন্য একটা বড় পাওয়া। তথাকথিত আগরতলা মামলা সাজানো হলো। যাতে উনি বেল (জামিন) না পান। বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, দেখো, এখানে বড় বড় ল ইয়ার আছে। কিন্তু কোনো কিছু করতে হলে আমি তোমার মাধ্যমেই করব। কারণ আমার আশঙ্কা হচ্ছে, অন্যান্য ল ইয়ার সরকারের কথামতো কিছু করে বসতে পারে। তুমি দেখবে, এটা যেন না হয়। এ জন্য আমি তোমাকে রাখতে চাই। সেটা আমি করলাম। তখন এ মামলায় একজন কৌঁসুলি হিসেবে থাকলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি বিশ্বাস করি, তুমি আমার ইচ্ছার বিপক্ষে কিছু করবে না। অন্য কারও দ্বারা প্রভাবান্বিত হবে না। আমার প্রতি বঙ্গবন্ধুর যে বিশ্বাস ছিল, সেটা রক্ষা করতে পেরেছি আমি।

প্রশ্ন: '৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধু আপনাকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রস্তুত করতে বলেছিলেন। এই সময়ের প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলুন।

উত্তর: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন, তুমি স্বাধীনতার ঘোষণার একটা খসড়া দাঁড় করাও। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করতে হলে এটা প্রস্তুত রাখতে হবে। এ সময় বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেখেছি। তবে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাটি বিভিন্ন বইয়ে পাওয়া যেত। এটা ভালো করে দেখেছি। স্বাধীনতার ঘোষণায় আমরা বলেছি, বাঙালি জাতির ন্যায্য যে দাবি, চাহিদা, অধিকার; তা দিতে হবে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ওপর আমাদের কর্তৃত্ব থাকতে হবে। জনগণই এখানে ক্ষমতার মালিক হিসেবে থাকবে। ভূমিকা রাখবে। তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ শাসন করবে। উনি (বঙ্গবন্ধু) বললেন, '৪৭ সাল থেকেই আমরা শোষণের শিকার হয়ে আসছি। পাকিস্তানে বাঙালিরা ৫৬ শতাংশ। আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু আমাদের ন্যায্য দাবিগুলো উপেক্ষা করে শোষণ করছে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। ৬ দফার মূল কথা ছিল আমাদের এখানে অন্য কারও কর্তৃত্ব থাকতে পারবে না। শুধু বাঙালিদের কর্তৃত্ব থাকবে এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ওপর।

প্রশ্ন: ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। এ সময় বঙ্গবন্ধুর একান্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন আপনি। ঐতিহাসিক এই ভাষণের স্মৃতিচারণ করুন।

উত্তর: ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। উনি সারাজীবন ধরে যা বলেছেন, সেটা করেছেন। আর উনি যে ভাষায় বলতেন, সেখানে না বোঝার কিছু থাকত না। এগুলো উনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতেন। এবং এটাই সত্যি, উনি যা বলেছেন শেষ পর্যন্ত সেটা করেই দেখিয়েছেন। উনি বলার জন্য বলতেন না। এ কারণে দলে উনার চেয়ে সিনিয়র মানুষ থাকলেও উনার প্রতি মানুষের আর্কষণ বাড়তে থাকল। সবার আস্থার জায়গায় তিনি চলে গেলেন। উনি স্পষ্ট করে বলেছেন, আমরা ফসল উৎপাদন করি, আর ভোগ করে পশ্চিমারা। এটা চলতে পারে না। আমাদের সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব থাকবে একমাত্র বাঙালির। আমরা পরিশ্রম করি, কিন্তু ফল ভোগ করে পশ্চিমারা। এটা বন্ধ হতে হবে। নতুবা বাঙালি জাতি শোষিত হিসেবেই থেকে যাবে। ৬ দফা তিনি মানুষের কাছে নিয়ে যান। জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হন। বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন তিনি।

৭ মার্চের ভাষণ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। লাখ লাখ মানুষ সেদিন রেসকোর্স ময়দানে। কিন্তু সুন্দর-সুশৃঙ্খল সবাই। কোনো রকম ঠেলাঠেলি, ধস্তাধস্তি নেই। বঙ্গবন্ধু লম্বা বক্ততাও দেন নাই। তিনি সহজভাবেই বললেন। তখন থেকেই শুরু হলো আমাদের মুক্তির শেষ চেষ্টা।

প্রশ্ন: ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তারের সময় আপনি কোথায় ছিলেন? ওই সময়ের কিছু কথা বলুন।

উত্তর: ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমরা দেখা করি। আমরা মানে তাজউদ্দীন ভাই, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং আমি। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, তোমরা সরে যাও। এখানে অবস্থা অন্য রকম হলে তোমরা নদী পার হয়ে গ্রাম-দেশে চলে যাও। আর দেরি করো না। ২৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে আমরা বেরুতে যাচ্ছি, এমন সময় আমাদের একজন সহকর্মী এমপি এসে বললেন, নিউমার্কেটের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে সরকারের লোকেরা। তখন সিদ্ধান্ত হলো- আমরা আজ ধানমন্ডির আশেপাশে কোথাও রাত কাটাব। সকালে সুযোগ পেলে আমরা বের হবো। রাতে প্রচুর গোলাগুলি হলো। মনে হলো, যুদ্ধ চলছে। তিনজন একসঙ্গে থাকাটা সমস্যা হতে পারে। এ কথা ভেবে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। এর পর কয়েক দিন এ-বাড়ি থাকি; কাল ও-বাড়ি থাকি। এভাবে চলে গেল। এর পর ২ বা ৩ এপ্রিল হঠাৎ শুনলাম, মিলিটারি বাড়ি ঘেরাও করেছে। আমি তখন লালমাটিয়ায় আমার এক আত্মীয়ের বাসায় ছিলাম। এর পর আমাকে ওরা অ্যারেষ্ট করে নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টে। সেখান থেকে নিয়ে যায় পাকিস্তানে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে। বঙ্গবন্ধু তখন মুক্তি পাওয়ার পথে। আমাকে চালাকি করে ওরা (পাকিস্তানি শাসকরা) বলল, দেখ, তুমি কিছু না বললেও উনি তো সবকিছু আমাদের বলে দিয়েছেন। শেখ মুজিবের জীবন তো শেষ। তিনি আর বাঁচতে পারবেন না। এখন তুমি কিছু বলো। আমাদের কাছে তোমাদের আর কিছু গোপন নেই। আসলে এটা ছিল পুরো ভাঁওতাবাজি। যাই হোক আমার কাছ থেকেও ওরা কিছু পেল না। অমাকে বলল, দেখ, তোমার বাচ্চারা ছোট। তুমি কিছু বলো। কাদের প্ররোচনায় তোমরা এগুলো (মুক্তিযুদ্ধ) করছ, সেটা লিখিত দাও। কারণ ওদের ধারণা ছিল, আমরা বিদেশি কোনো শক্তির প্ররোচনায় এই যুদ্ধ করছি। এর পর আমি লিখিত একটা কাগজ দিলাম। সেটা পড়ে তারা আমার ওপর আরও ক্ষিপ্ত হলো। নাখোশ হলো। কারণ ওখানে আমি লিখেছিলাম বাঙালির স্বাধীনতার যুক্তিসঙ্গত কারণগুলো। তখন তারা বলল, তোমারও বিচার হবে, শাস্তি হবে। তারা লিখিত চাচ্ছিল- বিদেশি শক্তির ইন্ধনে এসব হচ্ছে। এগুলো লিখিতভাবে তাদেরকে বলি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ স্বাধীনের পর লন্ডন হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশে ফিরলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। এ সময়ে দেশ গঠন বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা বা চিন্তাভাবনা সম্পর্কে কী আলোচনা হয়েছিল?

উত্তর: উনি বারবার বলেছেন যে, দেখ, দীর্ঘকাল ওরা আমাদের বঞ্চিত করেছে। এখন দেশটাকে গড়তে হবে। আমাদের সম্পদ আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এখানে কোনো ভুল করা যাবে না। ২৪ বছর ধরে আমাদের পাট সম্পদ, ফসলাদি সবই তারা তুলে নিয়ে গেছে। এখন এটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে বলেছিলেন, বাঙালি জাতি কখনও ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাও তাদের জানিয়েছে, বাঙালিরা কখনোই ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না- এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। ফলে শেখ মুজিব কিছুই করতে পারবে না। ফিরে আসার পথে আমি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, আপনি তো ইতিহাস পাল্টে দিলেন। বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করলেন। বাঙালি জাতি স্বাধীন হলো। বঙ্গবন্ধু শুধু হাসলেন।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের সংবিধান রচনার অভিজ্ঞতা, স্মৃতি ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা নিয়ে কিছু বলুন।

উত্তর: আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় আমি বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় প্রধান ভূমিকা পালন করি। বঙ্গবন্ধু আগরতলা মামলায় মুক্তির পরই এ বিষয়ে আমাকে বলেছিলেন- আমরা কী চাই, তা সব তোমাকে বলব। তুমি সেভাবে একটা সংবিধানের খসড়া করবে। এটা আমার ভাগ্য। বঙ্গবন্ধু আমার ওপর আস্থা রেখেছিলেন। '৭২ সালে এভাবে সংবিধান হলো। অনেকেই বলেন, এত তাড়াতাড়ি কীভাবে এটি রচিত হলো? কিন্তু এটা আগেই বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন।

প্রশ্ন :বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আপনি। বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে কিছু বলুন।

উত্তর: আমাদের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকবে। কারও সঙ্গে শত্রুতা করা হবে না। জনগণের ঐক্যের ভিত্তিতে যে শক্তি সৃষ্টি হবে, সেটা ধরে আমরা দেশ গড়ে তুলব। '৭৩ থেকে '৭৫ সাল পর্যন্ত আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলাম। এ সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেক দেশে সরকারি সফরে গেছি। একবার লন্ডনে গিয়ে নামলাম। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সবাই স্ট্যাচুর (মূর্তি) মতো দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ একজন পুলিশ সদস্য প্রটোকল ভেঙে এসে বঙ্গবন্ধুকে বলল, আপনার জন্য আমরা প্রার্থনা করছিলাম- আপনি যেন বেঁচে থাকেন। ওরা যেন আপনাকে হত্যা করতে না পারে। বঙ্গবন্ধু সারাবিশ্বেই এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন! লন্ডনের তরুণ সমাজ আমাদের মহান নেতাকে সম্মান জানিয়েছে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে গেলেন বঙ্গবন্ধু। ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। তিনি গোটা বিশ্বের কাছে কৃতজ্ঞতা জানালেন। কারণ সারাবিশ্বের মানুষ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এই ভাষণ শেষে কয়েকজন ইউরোপীয় নাগরিক আমাকে এসে বললেন, তোমার নেতার ভাষা (বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন) আমরা বুঝতে পারিনি ঠিকই। তবে তোমার নেতার দৃঢ়তা এবং বাচনভঙ্গি দেখে আমরা বুঝতে পারছি- এই মানুষটি অনেক সাহসী।

প্রশ্ন: '৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার সময় আপনি কোথায় ছিলেন? সে সময়ের অনুভূতি প্রকাশ করুন।

উত্তর: এ সময় আমি ছিলাম যুগোস্লাভিয়াতে। আমি যেতে চাইনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমাকে এক প্রকার ঠেলে পাঠিয়েছিলেন ওই দেশে। সেখানে একটা সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। মার্শাল টিটো বড় ভূমিকা রাখবেন এ সম্মেলনে। বঙ্গবন্ধুরও যাওয়ার কথা। এ জন্য যুগোস্লাভিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে দাওয়াত দিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু তিন দিনের জন্য আমাকে যুগোস্লাভিয়া পাঠালেন। সেখানে থাকতেই শুনলাম সেই জঘন্য ও মর্মান্তিক সংবাদ। যুগোস্লাভিয়ার প্রশাসনের লোকেরা আমাকে বলল, তুমি এখানে থেকে যাও। এখন দেশে যেও না। তোমাকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে। তুমি এখানে থাকো। আমি বললাম, না, আমি লন্ডনে যাব। সেখানে আমার দেশের অনেক বাঙালি আছে। ইতিহাসের এই জঘন্যতম ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত। বাঙালি জাতির ওপর আঘাত। বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে আশঙ্কা ছিল। কিন্তু এ রকম একটা ঘটনা ঘটবেই- এটা কখনও আমরা কল্পনা করতে পারিনি।

প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ ও বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য কী? বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ গড়তে কী কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর: আমাদের কাছে স্বাক্ষরিত দলিল রেখে গেছেন বঙ্গবন্ধু। এটা হলো বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান। এখানে সবই বলা আছে- উনি কী চেয়েছিলেন। জনগণ হবে ক্ষমতার মালিক। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ হবে। শোষণমুক্ত দেশ হবে। ধর্ম ধর্মের জায়গায় থাকবে। ধর্ম নিয়ে কেউ রাজনীতি করবে না। বঙ্গবন্ধু এই সংবিধানে স্বাক্ষর করেছেন। এখানে আইনের শাসনের কথা আছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা আছে। নারী-পুরুষ বৈষম্য নিরসনের কথা আছে। এই সংবিধান বদলানোর চেষ্টা হয়েছে বহুবার। কিন্তু কেউ সফল হননি। চেষ্টা করেও কেউ বদলাতে পারেননি। ফলে এই সংবিধান অনুসরণ করলেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।
দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, এটা ঠিক। নারীশিক্ষা বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষার মান বাড়েনি। বৈষম্য বেড়েছে গ্রাম ও শহরের মধ্যে। কিছু ধনী লোক বেড়েছে। তবে পাকিস্তানের মতো ২২ পরিবার চলবে না। এখানে সবারই খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। সংবিধানে এটা বলা আছে। এখন তো আমরা সবাই মিলে বলতে পারি, আসুন, সবাই মিলে সংবিধানটা বাস্তবায়ন করি। এখনও সময় আছে। এ কাজটাতে সবাইকে গুরুত্ব দিতে হবে। এটা করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সত্যিকার অর্থে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শিশুদের সামনে তুলে ধরতে হবে। বঙ্গবন্ধু ৫৫ বছরেই জীবন দিলেন! কত জেল-জুলুম-অত্যাচার সহ্য করলেন। একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু শত্রুরা তাকে বাঁচতে দিল না। এখন আমাদের বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে।


ড. কামাল হোসেন: বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী, গণফোরাম সভাপতি

বিষয় : সা ক্ষা ৎ কা র

মন্তব্য করুন