ভূমি ও বনের সঙ্গে আদিবাসীদের সম্পর্ক জন্ম-জন্মান্তরের। আদিবাসীরা ভূমি ও অরণ্যের সন্তান। এজন্য আদিবাসীদের ভূমিপুত্র বলা হয়ে থাকে। আদিবাসীদের ভূমি ও বন রক্ষার লড়াই ঐতিহাসিক সময় থেকেই চলছে। ভূমি ও বন রক্ষায় সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহ, টঙ্কবিরোধী বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, মধুপুরের শালবন রক্ষা আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে। এখনও আদিবাসীদের ভূমি রক্ষার আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলন করতে গিয়ে অনেককে আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। সিধু মুর্মু, কানু মুর্মু, বীরসা মুন্ডা, রাসিমনি হাজং, চলেশ রিছিল, আলফ্রেড সরেন তাদের অন্যতম। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আদিবাসীদের অধিকার সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা না পেলেও আংশিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।

১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৯৫ সালে মুন্ডাদের অধিকার রক্ষায় বীরসা মুন্ডার নেতৃত্বে আন্দোলন, ১৯৩৭ সালে শুরু হওয়া কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে টঙ্কবিরোধী আন্দোলনে রাসমনি হাজংসহ উল্লেখযোগ্য আদিবাসীর   আত্মত্যাগের পথেই আমরা আলফ্রেড সরেনকে দেখি।

আদিবাসীদের ভূমির অধিকারের আন্দোলনে আলফ্রেড সরেন ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট ভূমিদস্যুদের হামলায় নির্মমভাবে নিহত হন। নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুরের ভূমিহীন মানুষের জন্য তিনি খাসজমি বন্দোবস্তের আন্দোলন করছিলেন। তিনি জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ভীমপুর ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। সকাল ১১টায় সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলা শুরু হয় আদিবাসী পরিবারের ওপর। স্থানীয় ভূমিদস্যু সন্ত্রাসী হাতেম আলী ও সীতেশ ভট্টাচার্য ওরফে গদাইয়ের ভাড়াটিয়া লাঠিয়াল বাহিনী ও সন্ত্রাসীরা একের পর এক ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। ভাংচুর করতে থাকে বাড়িঘর। সন্ত্রাসীদের পাশবিক নির্যাতন থেকে বৃদ্ধ, শিশু, নারী কেউই বাদ যায়নি। খুনিরা খুঁজতে থাকে আলফ্রেড সরেনকে। খুনিদের একের পর এক আঘাতে আলফ্রেড সরেন লুটিয়ে পড়েন। রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায় ভীমপুর আদিবাসী পল্লির মাটি। সন্ত্রাসীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ১৩টি আদিবাসী পরিবারের ঘর। হামলায় গুরুতর আহত হয় ৩০/৩৫ জন আদিবাসী।

আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা করেন। ওই মামলায় মহাদেবপুর থানা পুলিশ তদন্ত শেষে ৯১ জন আসামির নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পুলিশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তারও করেছিল। নওগাঁ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৪১ সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়। মামলার প্রধান দুই আসামি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাতেম আলী ও সীতেশ ভট্টাচার্য গদাইসহ ৬০ জন জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে হাইকোর্ট তিন মাসের জন্য মামলাটির স্থগিতাদেশ দেন। এই সুযোগে আদালত থেকে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসে। মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। আসামিরা জামিনে বের হয়ে বিভিন্ন সময় আলফ্রেড সরেনের পরিবার ও সাক্ষীদের হুমকি দিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে অনেকে সেখান থেকে অন্যত্র চলে গেছে ও দেশত্যাগ করেছে। এমনকি নিহত আলফ্রেড সরেনের স্ত্রী-সন্তানও এখন সেখানে থাকেন না। 

আলফ্রেড সরেনের সংগ্রাম ছিল ভূমিহীন ও আদিবাসী মানুষের অধিকার আদায়ের। তার বাড়ির পাশেই প্রায় ৯৫ একর খাসজমি রয়েছে। সেই জমি ভূমিহীন ও আদিবাসীদের বন্দোবস্তের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন। সেজন্যই তাকে খুন হতে হয়। আজও সেই জমির অধিকাংশই খুনিরাই ভোগদখল করে আছে। কিন্তু বিচার হয়নি আলফ্রেড সরেন হত্যার। নওগাঁ জেলা ও দায়রা আদালত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই ৯৫ একর খাসজমির ৬৩ বিঘা আলফ্রেড সরেন ও গংয়ের অনুকূলে বন্দোবস্ত দেন। কিন্তু ভূমিদস্যুদের পক্ষ হয়ে মহাদেবপুর থানা পুলিশ প্রশাসন আলফ্রেড সরেনের বোন রেবেকা সরেনের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করে নামমাত্র ৩০ বিঘা জমি আদিবাসীদের ব্যবহারের অনুমতি দেয়। বর্তমানে আদিবাসীরা সেখানকার ৩০ বিঘা জমি ভোগদখল করছে। বাকি জমি আলফ্রেড সরেনের হত্যাকারীরা ভোগদখল করছে। আদিবাসীদের ভূমির অধিকার আন্দোলনে আলফ্রেড সরেনের আত্মত্যাগ আদিবাসীদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।

কেন্দ্রীয় সদস্য, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ

বিষয় : আদিবাসী আন্দোলন বিভূতী ভূষণ মাহাতো

মন্তব্য করুন