আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নামে আমরা সাধারণ মানুষের কর্মক্ষেত্র তথা কৃষি-অর্থনীতি নষ্ট করে বেকারত্ব বৃদ্ধি করলাম। বর্তমান করোনা মহামারি সময়ে অধিকাংশ সেবা, শিল্প, বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দেয়নি; বরং কৃষি ও স্বল্পশিক্ষিত কৃষকই আমাদের বাঁচিয়েছেন। উচ্চশিক্ষার সনদপ্রাপ্ত বেকারত্ব বৃদ্ধির জন্য আমরা রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক বাজেটের অনেকখানি ব্যয় করলাম। আসলে এই শিক্ষাব্যবস্থা কার জন্য?


প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে মানসম্মত কর্মসংস্থান। সে লক্ষ্যে স্কুল ও কলেজপড়ূয়াদের সংখ্যা বেড়েছে। আর বেড়েছে শিক্ষার প্রসার ও বাণিজ্য। ২০১৯ সালে মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ২১ লাখ ২৭ হাজার ৫৯৪ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছে ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৫ জন।

আর ২০১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোয় পড়ার সুযোগ আছে প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থীর। বেসরকারি ও বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির সক্ষমতা অনেকের থাকলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তারপরও প্রতিবছর লক্ষাধিক যুবক উচ্চশিক্ষা লাভ করে দেশের মধ্যে চাকরি অনুসন্ধান করতে থাকে। কারণ, আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যা পড়ানো হয়, তা দিয়ে দেশের বাইরে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে সম্মানজনক চাকরির যোগ্যতা অর্জন করে না; বরং দেশের উল্লেখযোগ্য কিছু পদে বাইরের দেশের শিক্ষিত ও অভিজ্ঞদের নিয়োগ করতে হয়। আবার বিদেশে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা অপ্রতুল এবং প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

প্রতিবছর বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি পদগুলোর জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের ফল অনুসারে মাত্র ১৪ হাজার ৪০৯ জন বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছে। আর নন-ক্যাডারে প্রায় সমসংখ্যক নিয়োগ পেয়েছে। সর্বশেষ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনা করলে দেখা যায়, এখনও যুবকদের প্রায় ৯৮ শতাংশ সম্মানজনক চাকরির সন্ধানপ্রার্থী। আর বাংলাদেশে সব বয়সের মোট শ্রমশক্তির একটি অংশ এখনও বেকার।

দেখা যাচ্ছে, দেশে সম্মানজনক চাকরি মানেই বিসিএস ক্যাডার। চাকরির প্রথম দিন থেকেই নন-ক্যাডারসহ দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির দায়িত্বে নিয়োজিত সব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও বয়োজ্যেষ্ঠদের অধিকর্তা। মেয়াদান্তে প্রমোশন ও উচ্চ পদে আসীন হওয়ার সম্ভাবনা। পদমর্যাদা অনুসারে সরকারি বাসভবন। কয়েক ধাপ পেরোলেই সরকারি গাড়ি। সব সরকারি সেবায় অগ্রাধিকার। সম্পূর্ণ সরকারি খরচে পকেটমানিসহ বিদেশ ভ্রমণ। সরকারি খরচে আরও উচ্চতর ডিগ্রি লাভের সুযোগ। আমৃত্যু সরকারি পেনশন। সরকারি ব্যবস্থাপনার আবাসন প্রকল্পে প্লট ও ফ্ল্যাট পাওয়ার কোটা। উচ্চপদে আসীন হতে পারলে ভিআইপি মর্যাদায় অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। তা ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে সীমাহীন সম্পদ অর্জনের সুযোগ তো থাকছেই।

সর্বোপরি, জনগণের দেওয়া বাজেটের টাকায় তাদের বেতন-বোনাসসহ সব সুযোগ নিশ্চিত করা হলেও রাষ্ট্রপ্রদত্ত ক্ষমতার তুলনায় জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্নীতি করলেও আইনত তার বিরুদ্ধে সহজে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। অর্থাৎ শুধু বিসিএস পরীক্ষার ফল দেশের ২ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত যুবককে সব নাগরিক থেকে আলাদা করে ফেলে। উল্লেখ্য, বিসিএস পরীক্ষার ভালো ফল সরকারি কোনো পদের জন্য কর্মক্ষমতা প্রমাণ করে না। চাকরিতে যোগদানের পরে নিবিড় তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য বা অযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা হয়। তবে এ প্রক্রিয়া ৯৫ শতাংশ শিক্ষিত যুবকের যোগ্যতাকে ম্লান করে দেয়, অপমানিত এবং অসম্মানিত করে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৈরি করা, রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোর ধারাবাহিকতায় এই তিন স্তরের নিয়োগ এখনও চলমান আছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় সব ক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সব ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি বাতিল হলেও কাঠামোগত বঞ্চনা ধারাবাহিকতা রয়েই গেছে। এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের আইন ও বিধির অধীনে সামান্য অজুহাতে খাদ্য উৎপাদক ও সাধারণ করদাতাকেও অপমান, অসম্মান বা শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থাকে মনে করিয়ে দেয়।

অন্যদিকে, বেসরকারি প্রায় সব চাকরিই অস্থায়ী ও অনিশ্চিত। উপরন্তু যারা ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়, তাদের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ও ক্ষমতার অপব্যবহার দেখে, ক্লাসের সহপাঠীসহ দেশের খাদ্য উৎপাদক ও করদাতাদের দারুণভাবে আহত ও ক্ষতবিক্ষত করে। এর সমাধান হচ্ছে, তিন স্তরের নিয়োগ বন্ধ করতে হবে এবং আইন দ্বারা জনগণের সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে। আর খাদ্য উৎপাদক ও সাধারণ করদাতাদের সম্মান দিতে হবে।

৩৯তম বিশেষ বিসিএস ছাড়া বিগত সাধারণ বিসিএস পরীক্ষার তথ্য বিশ্নেষণে দেখা যায়, প্রতিটি পরীক্ষায় গড়ে ২৭০ হাজার যুবক অংশগ্রহণ করেছে। প্রাথমিক ও লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছে গড়ে ১০ হাজার ৭০০ জন, আর পাসের হার মাত্র ৪ শতাংশ। ৩৯তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার প্রাথমিক পরীক্ষায় পাসের হার মাত্র ৩৪.৪২ শতাংশ।

পদের শূন্যতা সাপেক্ষে প্রতিবছর বিসিএস বিভিন্ন ক্যাডারে গড়ে দুই হাজার যুবক নিয়োগ পেয়েছে, যা মোট আবেদনকারীর মাত্র ০.৭৪ শতাংশ। তবে একই পরীক্ষার ফল থেকে বিসিএস নন-ক্যাডার পদে প্রায় সমসংখ্যক যুবক নিয়োগ পেয়ে থাকে। তাতে সর্বসাকল্যে ২ শতাংশের বেশি নিয়োগ পায় না।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কারিকুলাম ও পাঠ্যসূচি অনুসারে কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ বছরের কোর্স সম্পন্ন করে, কমপক্ষে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করা শিক্ষার্থীরাই কেবল বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনো কোর্সে বা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল আবশ্যক। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, অতীতের এত সব পরীক্ষায় পাস করার পর সাধারণ বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় পাসের হার ৪ শতাংশের বেশি নয় কেন?

অর্থাৎ দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও তার পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতির অবশ্যই গরমিল আছে। যারা বিসিএস পাস করে তাদের অনেক বেশি গাইডবই নির্ভর হতে হয়। তা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি চাকরি বা কর্মক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়-প্রদত্ত শিক্ষা খুব কমই কাজে লাগে। এই শিক্ষার সনদ নেওয়ার জন্য তাহলে কেন এত ব্যয়, এত কষ্ট ও সময়ক্ষেপণ?

অন্যদিকে, আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নামে আমরা সাধারণ মানুষের কর্মক্ষেত্র তথা কৃষি-অর্থনীতি নষ্ট করে বেকারত্ব বৃদ্ধি করলাম। বর্তমান করোনা মহামারি সময়ে অধিকাংশ সেবা, শিল্প, বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দেয়নি; বরং কৃষি ও স্বল্পশিক্ষিত কৃষকই আমাদের বাঁচিয়েছেন। উচ্চশিক্ষার সনদপ্রাপ্ত বেকারত্ব বৃদ্ধির জন্য আমরা রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক বাজেটের অনেকখানি ব্যয় করছি। আসলে এই শিক্ষাব্যবস্থা কার জন্য? তার পরও সান্ত্বনা পেতাম যদি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতরা উচ্চ পদে আসীন হওয়ার পর সব ক্ষেত্রে অন্তত দেশপ্রেম, খাদ্য উৎপাদক ও করদাতাকে সম্মান দেওয়াসহ নৈতিকতার সংস্কৃতি চালু করার প্রমাণ পাওয়া যেত। সবশেষে আমাদের দেশে মানসম্মত কর্মমুখী শিক্ষা চালু হতে আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে?

গবেষক ও লেখক