
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান করোনা ভ্যাকসিনকে কেন্দ্র করে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এই ভ্যাকসিন নিয়ে যদি জাতীয়তাবাদী লড়াই হয়, তাহলে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা কখনও সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে আলোচনার আগে আমাদের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে কিছু আলোচনা করা দরকার। বাংলাদেশে করোনা প্রকাশ পায় ৮ মার্চ ২০২০। চীনের উহান প্রদেশে নভেম্বর ২০১৯ সালেই করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটে। তিন মাস সময় হাতে ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি বিষয়টিতে। বিশেষ করে মাস্ক এবং পিপিই পর্যাপ্ত সংগ্রহের একটা উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। এরপর যখন ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেল, তখন কোথা থেকে কিছু বর্ণচোরা ব্যক্তির আগমন ঘটল। তাদের কেউ মাস্ক দলে হঠাৎ প্রবেশ করে, ফটোসেশন করে এবং টিভিতে টকশোর মাধ্যমে নিজেদের জাহির করল এবং একদিকে নকল ও ব্যবহার অযোগ্য মাস্ক এবং পিপিই আমদানি করল, অন্যদিকে করোনা পরীক্ষার জন্য ভুয়া কেন্দ্র খুলে বসল। ইতোমধ্যে গোটা বিশ্ব কাঁপছে করোনায়। সেদিকে এদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পৃথিবীর সব দেশে সব সময় দুর্নীতি হয়েছে, হয় এবং হবে। কিন্তু বাংলাদেশে যে দুর্নীতি হলো, সেটি বিশ্বে দুর্নীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করল। মানুষের মৃত্যু নিয়ে খেলা। নকল পিপিই আমদানি এবং সরবরাহের ফলে করোনার প্রত্যক্ষ সংগ্রামী- চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রাণ দিলেন। স্বাভাবিক রোগী তো আছেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চৈতন্যোদয় হলো। এখন অবশ্য কঠোরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে এবং দলমত নির্বিশেষে সব আসামির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে সব দোষ ও দায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর চাপানো হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা মন্ত্রণালয়ের কি কোনো দায়িত্ব ছিল না এই পরিস্থিতির ওপর নজর দেওয়ার? তারা তো ভিনগ্রহ থেকে আসেনি। আজকাল প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে পর্যাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছেন, যাদের কর্তব্য সংশ্নিষ্ট বিভাগ ও অধিদপ্তর এবং অন্যান্য সংস্থার ওপর নজর রাখার, যাতে কঠোরভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়- এই প্রত্যাশা আমাদের।
করোনা শুরু হওয়ার পর সঙ্গত কারণেই চিকিৎসকরা কিছুটা বিভ্রাটে ছিলেন পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাবে। অবস্থাদৃষ্টে এখন মনে হয়, বিভিন্ন লক্ষণ-পূর্ব লক্ষণকে অবলম্বন করে চিকিৎসা চালানো হচ্ছে এবং ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালও করোনার চিকিৎসা করছে এবং খোদার অশেষ কৃপায় সাফল্য পাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের একটি প্রখ্যাত চিকিৎসা কেন্দ্রে একটি পরিবারের তিন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন। তিনজনই আল্লাহর কৃপায় ভালো হয়েছেন। চতুর্থ জন তরুণ, বাইরে থেকে ওই হাসপাতালের পরামর্শে চিকিৎসা নিয়েছেন। তবে ব্যাপারটা একটু বেশি। ১৮ থেকে ২০ দিন ছিলেন। সর্বমোট সাড়ে চার লাখ টাকা দিতে হয়েছে। অন্য একজনের সঙ্গে আলাপ হলো, তিনিও তুলনামূলক তরুণ। সুস্থ হয়ে বেরিয়েছেন, ব্যয় হয়েছে এক লাখ ১৫ হাজার টাকা। তার বক্তব্য- তিনি অক্সিজেন ব্যবহার করেননি। নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছেন। নইলে আরও অনেক টাকা দিতে হতো। করোনায় সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। বিভিন্ন রোগের উপসর্গকে টার্গেট করে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে এবং আল্লাহর রহমতে সাফল্য আসছে। তাই চিকিৎসকরা প্রশংসার দাবিদার। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের ব্যয়ভার নিয়ে কিছুটা বিবেচনা করতে পারেন। আর সাধারণত একটি পরিবারে একাধিক রোগী হওয়াটা করোনার প্রায় রীতি বলা চলে, ফলে পরিবারের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে।
চিকিৎসায় অগ্রগতি হচ্ছে সেটি আশাব্যঞ্জক, কিন্তু এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে প্রয়োজন ভ্যাকসিনের। অতীতের মহামারিতে সেটিই প্রমাণ হয়েছে। তাই বিশ্বব্যাপী জোরালোভাবে গবেষণা চালানো হচ্ছে, যেটি বোধ হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধানের প্রত্যাশা- তা হলো বিশ্বব্যাপী সমন্বয়ের মাধ্যমে গবেষণা করে ভ্যাকসিন আবিস্কার হবে। বিশ্বের এত মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে হলে সার্বিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে- কিছু দেশ নিজেদের জন্য বেশি ব্যস্ত। যেমন ৬-৭ কোটি লোকের দেশ যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে ২৫ কোটি ডোজের জন্য চুক্তি করছে। যুক্তরাষ্ট্র যেন সবার আগে টিকা পায় সে জন্য দুটি কোম্পানিতে ৩৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। আমেরিকা ফার্স্ট- ট্রাম্পের এই নীতির ফলে সে দেশ থেকে সহজে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২৭টি দেশের জন্য ৩০ কোটি ডোজের জন্য চুক্তি করেছে। অক্সফোর্ডের উৎপাদিত টিকার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে ভারতের, চীনের সঙ্গে ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার চুক্তি হয়েছে। রাশিয়া বোধ হয় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। গত কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, রাশিয়ার সংক্রমণ প্রায় একরকম রয়েছে। গত কয়েকদিন আগে রাশিয়া সিএনএনকে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়ে দিল- তারা অনেকটা অগ্রসর হয়েছে এবং সেপ্টেম্বরে উৎপাদন এবং অক্টোবরে প্রয়োগে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন, নভেম্বরে নির্বাচনের আগে টিকা মিলতে পারে। মোটামুটি আশা করা যায়, আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারির ভেতর টিকা আসবে। বৈশ্বিক আঙ্গিক বিচার করলে দেখা যায়, খুব একটা সময় নেই। আমাদের ১৬ কোটি লোকের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে- একবার শুনলাম, চীনের সঙ্গে সব ঠিকঠাক। আইসিডিডিআর.বির মাধ্যমে চূড়ান্ত পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হবে। পরে আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলল- এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঠিক করবে। এটা কেমন ধরনের কথা, তা বুঝলাম না। মূল দায়িত্ব তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। আবার কয়েকদিন আগে স্বাস্থ্য সচিব জানালেন, বাংলাদেশ যেসব দেশ টিকা উৎপাদন করবে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এটা কী ধরনের যোগাযোগ। বিষয়টা কি টেবিলটকের মতো। যেখানে বিভিন্ন দেশ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে বসে রয়েছে, সেখানে চায়ের টেবিলে কথা বলার বিষয় কি এটা। স্বাস্থ্য সচিবের উচিত ছিল সুনির্দিষ্টভাবে জানানো কোন কোন কোম্পানির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। টিকা না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্বের কোনো দেশই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি চালু করবে বলে মনে হয় না। আর সেটি ঝুঁকিপূর্ণ। এই টিকা এক ডোজ দিলেই যে স্থায়ী প্রতিরোধ গড়ে উঠবে- প্লেগ, কলেরা, ম্যালেরিয়া, বসন্ত ঠেকাতে কতবার ধরে নিয়মিত টিকা/ইনজেকশন দিতে হয়েছে, বাংলাদেশের প্রয়োজন এ ব্যাপারটিকে আরও স্বচ্ছ এবং খোলাসাভাবে তুলে ধরা। সেই সঙ্গে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে, এই টিকা সংগ্রহে যেন ভুঁইফোঁড় রাজনীতিক, ফটোসেশন এবং টকশো ব্যক্তিদের আগমন না ঘটে। তারপর দেখা গেল, টিকার পরিবর্তে ডিস্টিলড ওয়াটার চলে এসেছে। করোনার দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটল, তাতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। টিকা সংগ্রহের বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। যদিও বহুদেশ ও প্রতিষ্ঠান গবেষণা করছে প্রাথমিকভাবে খুব বেশি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যাবে বলে মনে হয় না। আর ৭০০ কোটির জনবহুল বিশ্বে প্রয়োজনের কোনো অন্ত নেই। তাই আমাদের এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই যে, বিভিন্ন দেশ টিকার পসরা নিয়ে বসে থাকবে আর আমরা গিয়ে আমাদের পছন্দের জিনিস নিয়ে আসব। মনে রাখতে হবে, শতভাগ পোলিও টিকার সফলতায় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তর্জাতিকভাবে ভ্যাকসিন হিরো পদবিতে ভূষিত করা হয়েছে। সেটি অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে সেভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। পরে বিষয়টি পরিচালনা-পর্যালোচনা করার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় কমিটি করা যেতে পারে সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তির সমন্বয়ে। তবে কোনো ভুঁইফোঁড় ব্যক্তি নয়। এতে থাকবেন সরকারি আমলা তো বটে, তাছাড়া প্রখ্যাত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এবং খ্যাতনামা ওষুধ শিল্প ব্যক্তিত্ব।
পরিশেষে একটি কথা বলতে হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধান সতর্ক করেছেন- জাতীয়তাবাদী লড়াইয়ের বিষয়ে। পরিস্থিতি বুঝেই তিনি কথাটা বলেছেন। আমাদের অবস্থা হতে হবে অত্যন্ত পরিস্কার। আমরা কারও পক্ষে-বিপক্ষে নই। আমাদের আন্তর্জাতিক ক্ষমতা লড়াইয়ের লিপ্সা নেই। সবার সঙ্গে হৃদ্যতা রেখে এগিয়ে যাওয়াই তো আমাদের লক্ষ্য। ৫৫ হাজার বর্গমাইলে ১৬ কোটি মানুষের বাস। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জায়গা সংকুলান হওয়া কঠিন। আমাদের সংক্রমণ মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে। আমাদের প্রচেষ্টা হবে দ্রুত আমরা যাতে টিকা সংগ্রহ করতে পারি। আর কোনো সন্দেহের অনুপ্রেবেশ যেন না ঘটে।
কলাম লেখক ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
মন্তব্য করুন