জাতীয় সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি প্রথমে মহাজোট সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকের তুখোড় এই ছাত্রনেতা ১৯৬৩-৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাশেদ খান মেননের জন্ম ১৯৪৩ সালে, গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায়

সমকাল :বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার স্মৃতি বলবেন?
রাশেদ খান মেনন :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম দেখি বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের মিছিল থেকে। তিনি তখন একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করতেন। ঢাকার জিন্নাহ অ্যাভিনিউয়ে তার অফিস ছিল। আমরা যখন সেখান দিয়ে মিছিল করে যাচ্ছি, তখন বঙ্গবন্ধু তার অফিসের জানালা দিয়ে সেই মিছিলের উদ্দেশে হাত নাড়ছিলেন। এটাই তাকে আমার প্রথম চাক্ষুষ দেখা।
পরে শিক্ষা আন্দোলনের সময় মিছিলে গুলি হলে আমরা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম গুলির প্রতিবাদে হরতাল কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়ে, তার সমর্থন আদায়ের জন্য। সোহরাওয়ার্দী তখন ঢাকায় এসে ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বাসায় উঠেছিলেন। আমরা ছাত্র নেতাকর্মীরা সেখানেই গিয়েছিলাম সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী যখন কোনো কর্মসূচি দিতে চাইলেন না, তখন তৎকালীন ছাত্রনেতা বিশেষ করে কাজী জাফর আহমেদ ও শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে তার কিছুটা তর্কাতর্কি হয়। সেই সময় বঙ্গবন্ধু বললেন, 'ছাত্ররা যা বলছে তা তো ঠিকই বলছে।' বঙ্গবন্ধু ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে তার একাত্মতাও ঘোষণা করেছিলেন। যদিও সোহরাওয়ার্দীর কারণে পরে আর কোনো কর্মসূচি দেওয়া যায়নি। কিন্তু আমরা তখনই বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম একজন সংগ্রামী নেতা হিসেবে।
এর আগে অবশ্য বাষট্টির এপ্রিলে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করে আমরা যখন জেলে যাই, তখন বঙ্গবন্ধুও জেলে ছিলেন। ঢাকা কারাগারের পুরোনো হাজতের ১৮ সেলে আমাদের রাখা হয়েছিল। তিনি থাকতেন ২৬ সেলে। জানতাম যে, ২৬ সেলে শেখ মুজিবুর রহমান আছেন। কিন্তু সেখানেও তার সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কারণ সেটা ছিল অনেক বড় একটা জায়গা।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়। সে সময় দাঙ্গাবিরোধী কমিটি গঠন করা হলে বঙ্গবন্ধু এর আহ্বায়ক হন। ডাকসুর ভিপি হিসেবে সেই কমিটিতে আমিও যুক্ত ছিলাম। আমরা একসঙ্গে নৃশংস দাঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফিরে আসার পথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের গাড়িতে লিফলেট ছুড়ে মারার অভিযোগে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের অফিস সম্পাদক নূরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই স্মৃতিটা মনে আছে এই কারণে, এটা ছিল সেই সময়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দাঙ্গার বিরুদ্ধে তখন সবাই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনটি পত্রিকায় একই শিরোনামে লেখা হয়েছিল, 'পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও'। এই দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে তখনকার ছাত্র আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করা অর্থাৎ তার সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
সমকাল :শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন?
মেনন :১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি দিলে সেটা দ্রুতই দেশের মানুষের দাবিতে পরিণত হয়। ফলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী, বিশেষ করে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খান শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা দায়ের করে তাকে জেলখানায় আটকে রাখেন। এতেও তারা সন্তুষ্ট হননি। পরে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' নামের মামলায় কিছু সামরিক অফিসারের সঙ্গে শেখ মুজিবকে যুক্ত করা হয়। সেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার তিনি প্রধান আসামি হলেন। মামলাটি সে সময় বিশাল প্রচার পেয়েছিল। মানুষ এটাকে শেখ মুজিব নয়, পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর আক্রোশ বলে মনে করছিল। সেই সময় ১১ দফাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান ঘটে। এই আন্দোলনের বিস্তৃতি ও জঙ্গিত্বের কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত অবস্থার পরিণতি বুঝতে পেরেছিল। আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে সমঝোতায় আসারও চেষ্টা করেন। এই সময় শেখ মুজিব অবস্থান নেন, মুক্ত মানুষ হিসেবে যেতে দিলেই কেবল গোলটেবিলে যাবেন তিনি। আন্দোলনটাও হয়ে গিয়েছিল শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিকেন্দ্রিক। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি মুক্তি পাওয়ার পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থেকে তাকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, সেখানেই ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়।
সমকাল :৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?
মেনন :বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের বেশ আগেই ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পল্টনের মিটিং থেকে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমের স্লোগান এবং কর্মসূচি দেওয়ার কারণে আমাকে সামরিক আদালতে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ওই সময়টায় আমি আত্মগোপনে ছিলাম। ইয়াহিয়া খান একাত্তরের ১ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলে আন্দোলন, হরতাল, বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু তখন বললেন, ৭ মার্চের জনসভায়ই তিনি তার কথা বলবেন। ইতোমধ্যে ছয় দফা কিন্তু এক দফায় পরিণত হয়েছে। আমাদের মনের মধ্যেও আশা ছিল, বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় নিশ্চয় দেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে কোনো কথা বলবেন। ৭ মার্চ আত্মগোপন অবস্থায় থেকে জহির রায়হানের গাড়িতে করে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের কোনায় যাই। সেখানে গাড়ি রেখে গাড়ির বনেটের ওপর বসে সেই বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনছিলাম। বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে তিনি বললেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। তখনই আমার মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত হলো, আর পিছিয়ে থাকার কোনো জায়গা নেই, বাংলাদেশ এখন এগিয়েই যাবে।
সমকাল :বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখা কবে?
মেনন :বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে আমরা মূলত বিরোধী দল হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ বাকশাল হয়ে যাওয়ায় সব রাজনৈতিক দল বাতিল হলেও বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের সঙ্গে একমত না থাকায় আমরা বাকশালে যাইনি। এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আমাকে আর রনোকে (হায়দার আকবর খান রনো) তার বাসায় ডেকেছিলেন বাকশাল সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তার বাসার লাইব্রেরি কক্ষে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের লাইব্রেরি কক্ষ) আমাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর এক ঘণ্টা কথা হয়েছিল। তিনি আমাদের বলেছিলেন, 'তোরা বাকশালে যোগ দে। কারণ আমি এখন সমাজতন্ত্র কায়েম করবো।' আমরা তাকে বলি, 'পরিস্থিতি যা আছে কিংবা আপনি বাকশালকে যেভাবে তৈরি করছেন, তাতে আমাদের ধারণা হলো- নতুন কিছু হচ্ছে না, সেই পুরোনো জিনিসই হচ্ছে। আপনার দলের সেই লোকগুলোও এখানে অবস্থান নিচ্ছে। আর দলের মধ্যে যে দলাদলি রয়েছে, তাতে আমাদের বাকশালের পক্ষে অবস্থান নেওয়া সেভাবে সম্ভব হবে না। সুতরাং আমরা বরং বাকশালে যোগদান থেকে বিরত থাকি। আর কখনও যদি মনে করেন আপনি আপনার বলা মত-পথে এগোচ্ছেন এবং আমাদের সঙ্গে নেবেন, তখন হয়তো আমরা আপনার সঙ্গে যোগ দেব।' তখন বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন, 'ঠিক আছে তোদের জয়েন করতে হবে না। তোরা দেখ আমি কী করি। ওয়াচ অ্যান্ড সি।' সেটাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা এবং শেষ কথা।
সমকাল :বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনের স্মৃতি কিছু বলবেন?
মেনন :তখন সারাদেশে প্রচুর গুঞ্জন ছিল। বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন ধরনের অবস্থানের কথা শোনা যাচ্ছিল। একদিকে যেমন দলে দলে লোক বাকশালে যোগদান করছিলেন, অন্যদিকে বাইরে গুঞ্জন ছিল সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা অন্য কিছু একটা হতে পারে। এই সময়কালে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সকালে আমার শ্বশুর বিবিসিতে খবর শুনে এসে আমাকে জানালেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। পরে রেডিওতে শুনলাম মেজর ডালিম বলছেন, 'বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হলো'। তখনই আমরা বুঝলাম যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পথ থেকে ১০ ধাপ কেন, হাজার ধাপ পিছিয়ে গেল। আরও বুঝলাম, সামনে একটা কঠিন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। পরবর্তীকালে সেটাই সত্য হয়েছিল।
সমকাল :বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধ- এই আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মেনন :এক কথায় মূল্যায়ন করলে বলা যায়, বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে আমাদের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে স্বাধিকার আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ দিয়েছেন। এখানে তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ ব্যাপারে তিনি দৃঢ়চিত্ত ছিলেন। কখনোই পেছনে ফিরে তাকাননি। সত্তরের নির্বাচনের মাধ্যমে ১৬৭ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবে তারই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ৭ মার্চের বক্তৃতায় তিনি পরিস্কার বললেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমি দেশের মানুষের মুক্তি চাই।' এর মধ্য দিয়েই কার্যত তিনি এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা হয়ে গড়ে ওঠেন। আর এই যে ইতিহাসের গতিধারা, সেখানে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তিনি 'মুজিব ভাই' থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন।
সমকাল :একজন দেশ শাসক তথা রাষ্ট্র পরিচালক হিসেবে বঙ্গবন্ধু কতটা সফল হয়েছিলেন?
মেনন :প্রথম কথা হচ্ছে, একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান বা তার যোগ্যতা সম্পর্কে কথা বলার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ তিনি আন্দোলন-সংগ্রাম করে ধাপে ধাপে একটি পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতার দরজায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন দেশ শাসনের প্রশ্ন আসে, তখন অনেক কিছুই বিশ্নেষণের প্রয়োজন হয়। বঙ্গবন্ধু যখন এই দায়িত্ব নেন, তখন বাংলাদেশ ছিল একটা পরিপূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ। সেই জায়গা থেকে দেশকে ফিরিয়ে আনা একটা কঠিন কাজই ছিল। কিন্তু আজকের দিনে এসে আমরা দেখি যে, তিনি তখন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন- সেগুলো অত্যন্ত যৌক্তিক ছিল। যেমন স্থলসীমা ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি। প্রায় ৪০ বছরের বেশি সময় পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আমলে চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির উদ্যোগ, বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইট স্থাপন, কৃষিতে সমবায়করণ, ভূমি সংস্কার, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, বাংলাদেশকে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত করা, জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেওয়া, নিজেকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা- এসবই ছিল বঙ্গবন্ধুর সেই সময়কার ঐতিহাসিক সব অর্জন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার শাসনকালে পুরোনো পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্রকে সেভাবে পরিবর্তন করতে পারেননি। ফলে প্রশাসনে গতি যেমন আসেনি, তেমনি প্রশাসনের আনুগত্যও তিনি পাননি। মূলত এ কারণেই তিনি বাকশালের মাধ্যমে প্রশাসন তথা আমলাতন্ত্রসহ সবাইকেই তার নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছিলেন। সেটা ভুল কি শুদ্ধ, তা পরের ব্যাপার। কিন্তু আমি বলব, দেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটকে উপলব্ধি করতে পারলেও তাকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। দলের লোকদের দুর্নীতি-লুটপাটও দমন করতে পারেননি। এমনকি সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে দুর্নীতি দমন ও চোরাচালান ঠেকানোর প্রচেষ্টা চালিয়েও তার দলের লোকদের চাপের কারণেই সেটা প্রত্যাহার করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। এসব কারণেই তিনি বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।' অর্থাৎ এই দুটি দিক মিলিয়ে বলা যায়, দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক যোগ্যতায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার দূরদর্শিতার কোনো অভাবই ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান আমলের পুরোনো শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখাটাই ছিল তার জন্য সবচেয়ে বড় ভুল পদক্ষেপ। জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের সময় ফিদেল কাস্ত্রোও তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, 'তুমি যে এদের টিকিয়ে রাখছ, দেখবে একদিন এরাই তোমাকে ছোবল মারবে।' সুতরাং প্র্যাকটিক্যালি ওই আমলাতন্ত্রই বঙ্গবন্ধুকে আর এগিয়ে যেতে দেয়নি। তারপরও বলব, একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করতে অন্ততপক্ষে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে যেসব ব্যবস্থা তিনি করে গিয়েছিলেন, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়- তাকে আরও সময় দেওয়া হলে বাংলাদেশ অবশ্যই অনেক আগেই আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত।