করোনার বিরূপ প্রভাবে জনসাধারণের জীবন-জীবিকায় যে আঘাত এসেছে, তা মোকাবিলায় প্রত্যাশিতভাবেই চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু এর সুফল ভোগ করছেন কারা? শুক্রবার সমকালে প্রকাশিত 'সামাজিক সুরক্ষায় সচ্ছলরাও, বঞ্চিত হতদরিদ্ররা' শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে সামাজিক সুরক্ষার নীতিগত দিক নিয়েই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। আমরা জানি, নীতিমালা অনুযায়ী শুধু হতদরিদ্ররাই সামাজিক সুরক্ষা বা সুবিধা পাবেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, সমাজের বহু সচ্ছল পরিবারও সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা নিচ্ছে! পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদসহ বেশ কিছু খাতে সামাজিক সুরক্ষার অর্থ ব্যয় হচ্ছে। যারা সঞ্চয়পত্র কেনার সামর্থ্য রাখেন, তারা কোনোভাবেই অসচ্ছল নন। এবারের বাজেটে যখন সঞ্চয়পত্রের সুদের পেনশনের টাকা সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ দেখানো হয়, তখন এ ব্যাপারে নানা মহল থেকে আপত্তি উঠেছিল এবং তা সংশোধিত বাজেটে রদ করার কথা বলা হয়েছিল। সামাজিক সুরক্ষার আওতায় এই দুই খাতে বরাদ্দ দেওয়ায় সুরক্ষা যাদের পাওয়ার কথা তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। নিকট অতীতে সিপিডি ও ব্র্যাকের এক গবেষণায় জানা গেছে, করোনা দুর্যোগে দেশে নতুন করে আরও অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ নানা দিকে কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ায় বেড়েছে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা।
দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া নতুন এবং পুরোনো মিলিয়ে এখন সেই নিরিখেই সামাজিক সুরক্ষার নীতি ও কার্যক্রম প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। করোনার অভিঘাত সামাজিক নিরাপত্তা কিংবা সুরক্ষায় নতুন এক বৈরী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বৃহদাংশের আয়-রোজগার কমে যাওয়ায়। করোনার প্রকোপ থেকে এখনও আমরা মুক্ত তো নই-ই, উপরন্তু এর ছায়া আরও বিস্তৃত হচ্ছে। এমতাবস্থায় দারিদ্র্যের হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। চার বছর আগে খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৭৫ শতাংশ সচ্ছল মানুষ সুবিধা পেয়েছেন- এই তথ্য আমাদের বিস্মিত না করে পারে না। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগও নতুন নয়। এতে একদিকে যেমন সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে যাদের সুবিধা পাওয়ার কথা তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। আপাতদৃষ্টিতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ অনেক বেশি মনে হলেও বাস্তবতা যে ভিন্ন, তা স্পষ্ট। পেনশন কিংবা সঞ্চয়পত্রের সুদের টাকা সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ থেকে কেন ব্যয় হবে? যেখানে সামর্থ্যবানরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে মুনাফা করেন, তাদের পেছনে সামাজিক সুরক্ষা খাতের বরাদ্দ থেকে ব্যয়ের বিষয়টি কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয় বলে আমরা মনে করি। আর অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তো হতদরিদ্র নন। সামাজিক সুরক্ষা তাদেরই দিতে হবে যারা আয়-রোজগারহীন কিংবা হতদরিদ্র। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুভঙ্করের ফাঁকি বন্ধ করা প্রয়োজন বৃহৎ স্বার্থেই। এর নিরসনে সরকারের অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর ক্ষেত্রে দরিদ্র কিংবা হতদরিদ্রদের যেসব সুবিধার কথা বলা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই তা দৃশ্যমান নয়।
সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নথিভুক্তদের সঙ্গে এখন কর্মচ্যুত পরিযায়ী মানুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। কভিড-১৯ মহামারিকালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা আছে বাংলাদেশে। আমরা জানি, ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর অনেকের কাছে সরকারের দেওয়া সুবিধা পৌঁছে না দায়িত্বশীল অসাধুদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে। যাদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি তারা সামাজিক সুরক্ষার নীতিমালা অনুযায়ী সহযোগিতা পাচ্ছেন কিনা তা নিশ্চিত করা দরকার। সরকারকে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত দুর্বলদের ওপর অর্থনৈতিক প্রভাব স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে স্বচ্ছতার সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, এ ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ ব্যাপক, তাই ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য গতানুগতিকতার ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এখনই।
মন্তব্য করুন