খোরপাশ কৃষি থেকে আধুনিক বাণিজ্যিক কৃষির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় কৃষিবিজ্ঞানী, গবেষক, সম্প্রসারণবিদ ও কৃষিনীতি প্রণেতারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি কাজটি করে থাকেন দেশের অসংখ্য ছোট-বড় কৃষি উদ্যোক্তা, যারা কষ্টার্জিত পুঁজি সংস্থান করে ও ঝুঁকি নিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির সমাহার ঘটিয়ে বিনিয়োগ করে থাকেন। এজন্য তাদের অভিজ্ঞতা, উৎসাহ ও সাহস সবই দরকার। তাত্ত্বিক জ্ঞান ও সৎ পরামর্শের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তাদের আরও বেশি প্রয়োজন আধুনিক খামার ব্যবস্থার চাক্ষুষ উদাহরণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশে এ সুযোগগুলো বেশ কম। শাইখ সিরাজ এ শূন্যতা অনেকাংশে পূরণ করে চলেছেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ হার্ভে লিবিনস্টাইনের মতে, উদ্যোক্তারা হচ্ছেন পরিবর্তনের মাধ্যম। কৃষি উদ্যোক্তারা প্রথমে নিজেরা এ পরিবর্তনটি সাধন করেন এবং পরে অন্যদের পরিবর্তন করতে পথ দেখান। শাইখ সিরাজ এ জায়গাটিতে দীর্ঘদিন ধরে বিরামহীনভাবে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন বাণিজ্যিক খামার-সংশ্নিষ্ট তার বস্তুনিষ্ঠ উদাহরণ ও মনোজ্ঞ উপস্থাপনার মাধ্যমে।
শাইখ সিরাজ তার 'হৃদয়ে মাটি ও মানুষ' ও 'হৃদয়ে মাটি ও মানুষের ডাক' অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাঠেঘাটে ঘুরে ঘুরে যেখানেই নতুন কোনো প্রযুক্তি বা লাভজনক কর্ম-উদ্যোগের সন্ধান পান সেখানেই ছুটে যান, ক্যামেরায় ধারণ করেন বাস্তব কর্মকাণ্ডের চিত্র, কথা বলেন কৃষক-শ্রমিক-খামারিদের সঙ্গে তাদের ক্ষেতখামারে দাঁড়িয়ে, তাদেরই ভাষায়। এভাবে তিনি বাংলাদেশে উন্নত ফসল ও সবজি চাষ, আধুনিক দেশি-বিদেশি ফল বাগান, বাণিজ্যিক হাঁস-মুরগির খামার, মৎস্য চাষ, ফুলের চাষ, মৌমাছি ও মধু, গাভী পালন ও দুগ্ধ উৎপাদন সবকিছু তুলে আনেন তার প্রখর দৃষ্টি আর অনুসন্ধিৎসু মন দিয়ে। শাইখ সিরাজ এখন গ্রাম ছাড়িয়ে নগর কৃষিকেও প্রচারে নিয়ে আসছেন। বিশেষ করে তার প্রচারিত ছাদ-কৃষিপ্রযুক্তি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের মাঝেও বেশ আগ্রহ সৃষ্টি করতে পেরেছেন।
শাইখ সিরাজ কৃষি যে একটি লাভজনক আধুনিক অভিজাত পেশা হতে পারে এ ধারণা ও বাস্তব উদাহরণগুলো দেশের উদীয়মান তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এটা সরকারের ঘোষিত তারুণ্যের শক্তিকে উৎপাদনশীল কাজে লাগানোর নীতির সঙ্গে বেশ সাযুজ্যপূর্ণ। নতুন উদ্যোক্তাদের পুঁজি-সংস্থান, মানসম্পন্ন উপকরণ প্রাপ্তি, পণ্য বিপণন ইত্যাদি সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কিত মতামত তুলে ধরছেন টেলিভিশন ও পত্রিকার মাধ্যমে। প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার আগে সরকারের মন্ত্রী ও নীতি প্রণেতাদের উপস্থিতিতে গ্রাম পর্যায়ে কৃষকদের সমাবেশ থেকে ধারণকৃত শাইখ সিরাজের কৃষি বাজেট অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত কার্যকর ও জনপ্রিয় হয়েছে। কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠানটি তার উদ্ভাবনীমূলক অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এর মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদের প্রায় হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলা, নৌকাবাইচ ও বিনোদন কার্যক্রমে কৃষকদের সরাসরি অংশগ্রহণ ও পুরস্কার দিয়ে নির্মল আনন্দ দানের ব্যবস্থা করা হয়। শাইখ সিরাজ এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের উন্নত কৃষির সঙ্গেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন টেলিভিশন মাধ্যমে। তরুণ উদ্যোক্তারা এতে উৎসাহিত হচ্ছেন, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত কৃষি উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। এটা একটা বড় কাজ। কেবল তাই নয়, আমাদের দেশের তরুণ উদ্যোক্তারা বিদেশের মাটিতে- যেমন জাপান, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে কীভাবে উন্নত প্রযুক্তি ও কলাকৌশল ব্যবহার করে আধুনিক উচ্চমূল্য কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, শাইখ সিরাজ তাও তুলে আনছেন সুণিপুণভাবে। এটা আমাদের উদীয়মান বাণিজ্যিক কৃষির জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয় ও উৎসাহব্যঞ্জক হয়ে উঠছে। একজন প্রতিবেদকের এটিই হচ্ছে সার্থকতা। তিনি মানুষকে উদ্দীপিত করছেন, কোন পথে এগোতে হবে তার ইশারা দিচ্ছেন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কৃষি কর্মকাণ্ড শুরু করার নৈতিক সাহস জোগাচ্ছেন। শাইখ সিরাজ সুস্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘজীবী হোন এবং তার দীর্ঘ পথপরিক্রমা আরও বিস্তৃত ও দীর্ঘস্থায়ী হোক।
সাবেক উপাচার্য, বাংলাদেশ
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয় : ড. এম. এ. সাত্তার মণ্ডল

মন্তব্য করুন