
এটা পরিস্কার করার জন্য যে, চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর ঘটনার পেছনে একটা ঐতিহাসিক প্রস্তুতি রয়েছে। মারাত্মক এই জীবাণুটি চীনের জৈব রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে বের হোক আর নাই হোক, তাদের অধুনা-অবলম্বিত পুঁজিবাদ থেকেই যে সে উৎপন্ন হয়েছে- সে ব্যাপারে তো বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই। অধুনা চীন অতি অল্প সময়ে অবিশ্বাস্য রকমের উন্নতি করেছে এটা ঠিক। কিন্তু সেই উন্নতিতে মানবিক মূল্যের দিকটা মনোযোগ পায়নি। জাতীয় সম্পদের বৃদ্ধি ঘটেছে, কিন্তু মানুষের নিরাপত্তা বাড়েনি, উল্টো কমেছে। তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে অত্যন্ত উন্নত- এটা প্রমাণ করার জন্য চীনের হাসপাতালে কত মিলিয়ন শয্যা রয়েছে, কত মিলিয়ন পেশাগত চিকিৎসক সে দেশে কাজ করছেন- এসবের পরিসংখ্যান প্রাসঙ্গিক বটে। কিন্তু খুবই জরুরি তো ছিল করোনাভাইরাসের মতো মানুষ ও মনুষ্যত্ব ধ্বংসে অভিলাষী জীবাণু যে তলে তলে যুদ্ধ-প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেটা জানা। জানলে এবং ব্যবস্থা নিলে বিশ্বব্যাপী মানুষের সমস্ত অর্জন এমনভাবে বিপদগ্রস্ত হতো না।
উহানে একটি অস্বাভাবিক রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে- এমন খবর সেখানকার একজন চিকিৎসক তার ফেসবুকে লিখেছিলেন। তার কথাকে মোটেই পাত্তা দেওয়া হয়নি। উল্টো তাকে ধমকে দেওয়া হয়েছিল গুজব ছড়ানোর দায়ে। চিকিৎসকের সতর্কবাণী বাসি হয়ে ফলেছে; এবং ফলবার ওই প্রক্রিয়াতে চিকিৎসক নিজেও প্রাণ দিয়েছেন। একইভাবে প্রাণ দিয়েছেন ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের একজন বাঙালি চিকিৎসক। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি একটি খোলা চিঠিতে লিখেছিলেন, চিকিৎসকদের যথোপযুক্ত ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তার সরঞ্জাম দেওয়া দরকার। তার কথা শোনার আগেই তিনি মারা গেছেন ওই করোনা রোগেই। তার চিকিৎসক স্ত্রীও আক্রান্ত হয়েছিলেন; তবে প্রাণে বেঁচে আছেন। চীন ও ব্রিটেন দুই দেশ ঠিকই, পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বীও, তবে ব্যবস্থা এখন একই।
একশ' বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লুর জন্যও কোনো কোনো মহল থেকে চীনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ওই সময়টাতে শ্রমিকের খুব দরকার পড়েছিল। চীনে সস্তা শ্রমিক পাওয়া যেত। চীন থেকে বহু শ্রমিক গিয়েছিল যুদ্ধরত ফ্রান্সে। গেছে তারা বদ্ধ ট্রাকে চেপে, গাদাগাদি করে। ফ্রান্সে গিয়ে থেকেছে নোংরা পরিবেশে। রোগটা তারাই ছড়িয়েছিল বলে একটা মত চালু আছে। ইতিহাসের বক্রাঘাত এখানে যে, একশ' বছর পরে এবার আর সন্দেহ নয়, বাস্তবিকই রোগটা ছড়িয়েছে সেই চীন থেকেই।
একশ' বছরে সভ্যতা অনেক এগিয়েছে; চীনও আগের সেই দুর্দশার অবস্থায় নেই। তবু রোগের দায়ভার যে তাকেই বহন করতে হলো। তাতে এটাই প্রমাণ হয়, যা এতক্ষণ বলছিলাম, চীনের উন্নতি মানুষ ও মনুষ্যত্বকে নিরাপদ করেনি। তবে এক সময়ে চীন যে সমাজতন্ত্রী হয়েছিল ও ছিল, সেটা তো মিথ্যা নয়। করোনা চিকিৎসার জন্য সাত দিনের ভেতর উহানে তারা যে রকমের একটা হাসপাতাল তৈরি করে ফেলেছে, সেটা বাইরের বিশ্বকে রীতিমতো অবাক করেছে। তারপরে আছে করোনা-সংক্রমণের নিয়ন্ত্রণ। সেটাও এমন দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে, যার তুলনা পুঁজিবাদী দুনিয়ার কোথাও পাওয়া যাবে না। একইভাবে সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার কারণে ভিয়েতনামও করোনাকে রুখে দিয়েছে নিজের সীমান্তে। আর কিউবার তো কথাই নেই। তার যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, তা পর্যায়ক্রমিক বহিঃস্থ আক্রমণেও বিপর্যস্ত হয়নি। সমাজতন্ত্রী কিউবা নিজেকে তো রক্ষা করেছেই, আগের মতোই অন্য দেশকেও সাহায্য করেছে। একদা-সমাজতন্ত্রী চীনও সাহায্যের জন্য অন্য দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাঠিয়েছে। বাংলাদেশেও এসেছিল একটি টিম।
ভারতের কেরালা রাজ্যে কমিউনিস্টদের যে শাসন অনেক কষ্টে টিকে আছে, করোনা ব্যবস্থাপনায় তার যে সাফল্য; তেমনটি বৃহৎ ভারতের অন্য কোথাও দেখা যায়নি। বোঝা যায় যে, কমিউনিস্টরা যা করতে পেরেছে, অন্যরা তা করতে পারেনি। তবে অন্যরা যে কী রকমের কাজ করতে পারে, তার নিদর্শনও পাওয়া গেছে। কিন্তু কেরালারই অকমিউনিস্টদের এক কাজে। খাদ্যের খোঁজে জঙ্গল থেকে একটি হাতি এসেছিল কেরালার একটি লোকালয়ে। লোকেরা কয়েকজন হাতিকে খুব খাতির করেছে। খেতে দিয়েছে। ক্ষুধার্ত হস্তী ভক্ষণ করেছে যা দিয়েছে তাই। তারপরেই কিন্তু বিস্টেম্ফারণ। খাদ্যের ভেতর লুকানো ছিল বোমা; হাতির দেহাভ্যন্তরে গিয়ে সেটি বিস্টেম্ফারিত হয়েছে। মরা হাতি যে লাখ টাকা- সে তো জানাই ছিল ওই লোকদের। সে জন্যই এই কর্ম সম্পাদন। এটা সেই আচরণেরই অংশ, যার দরুন প্রাণী ও প্রকৃতি আজ বিরূপ হয়েছে এবং প্রকৃতির কাছ থেকে নানা রকমের ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। করোনাভাইরাস তার একটি। এ বিষয়ে অনেক কথা বলা হবে, বলা হচ্ছেও। যেমন বলতে পারি, করোনার স্পিরিটের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। তা করোনার স্পিরিটটা কী? না, সেটা হলো বিচ্ছিন্নতা। করোনা যা বলছে, তা হলো বাঁচতে যদি চাও তাহলে যত তাড়াতাড়ি পার বিচ্ছিন্ন হও; সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখো। এই স্পিরিটের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অর্থ হচ্ছে সামাজিক হওয়া। সামাজিক হওয়াকেই কেউ হয়তো নাম দেবেন মানবিকতা। সে নামকরণ মোটেই অযথার্থ হবে না। সামাজিকতার ভেতরেই মানবিকতা থাকে এবং সামাজিকভাবেই মানবিকতা তথা মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়। বনের মানুষেরা ঠিক মানুষ নয়, বনমানুষ বটে। কিন্তু সামাজিক হওয়াটা কি সম্ভব হবে? করোনা যা করল তা তো মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দেওয়া। মানুষমাত্রেই রোগের জীবাণুবাহী, অতএব জাতশত্রু- এই ধারণা প্রোথিত করে দিতে চাইল মনের গভীরে। করোনা থাকবে না, কিন্তু ধারণাটা? সেটাও চলে যাবে বলে আমরা আশা করব। কিন্তু যাবে না, আর যায়ও যদি চলে, তবেও তার দাগটা থাকবে; নদী শেষ হয়ে গেলেও নদীর দাগটা যেমন থাকে। তবে এই দাগ কিছুতেই মুছে যাবে না।
অসহায় মানুষদের কেউ কেউ ধর্মের দিকে ঝুঁকবে। বলবে, যা ঘটছে তা মানুষের পাপাচারের ফল। অতএব ধর্মের কাছে যাও, সৃষ্টিকর্তার কাছে নত হয়ে প্রার্থনা কর। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র একটি জাতীয় দৈনিকে পত্র লিখে যে ধরনের আহ্বান জানিয়েছে, তেমন আন্তরিক কিন্তু অর্থহীন কথা শোনা যাবে। তার চিঠির শিরোনাম 'মানবতা আজ কোথায়? হাসপাতালে রোগীর প্রতি নিষ্ঠুরতা'। চিঠির ভেতরের মূল আহ্বান :আসুন, আমরা একটু মানবিক হই। করোনার ভয়ে পালিয়ে বেড়ালেই কি আমরা করোনা থেকে বাঁচতে পারব? না, পারব না। আমরা আপনজনের প্রতি নিষ্ঠুর না হয়ে মানবিক হলে মহান প্রতিপালকও আমাদের প্রতি মানবিক হবেন। তা তরুণ ছাত্রই-বা শুধু কেন, চিকিৎসকদের একটি সংগঠন তো দেখলাম তার সদস্যদের প্রতি বিজ্ঞাপন দিয়ে করোনা চিকিৎসায় ব্রতী হতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে।
বিজ্ঞ মানুষেরা কেউ কেউ বলছেন 'বাস্তবসম্মত' কথা। বলছেন, করোনা একটা অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ; এর মোকাবিলা করতে হবে। তারা বলছেন টিকা উদ্ভাবন, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন, চিকিৎসা গবেষণায় ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধিকরণ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যরক্ষার বিধি মেনে চলা, রোগীকে আইসোলেশনে রাখা, আরও ভালো কোয়ারেন্টাইন ইত্যাদির কথা। কিন্তু মূল চ্যালেঞ্জটা যেখান থেকে আসছে সেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মুখোমুখি দাঁড়ানো এবং তাকে বদলানোর কথাটা মোটেই বলছেন না। আর পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য চলছে বলে যারা মানেন, তারাও পুঁজিবাদের অগ্রভাগে বিশেষণ যোগ করে তার মুখ্য পরিচয়টাকে জানি না কেন অস্পষ্ট করে রাখতে চান। তাদের কাছ থেকে অবিকশিত পুঁজিবাদ, অনুন্নত পুঁজিবাদ, করপোরেট পুঁজিবাদ, নিও-লিবারেল পুঁজিবাদ, বিকৃত পুঁজিবাদ, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ইত্যাদির কথা শোনা যায়। এক নম্বর শত্রু হিসেবে এই মুহূর্তে যে দুর্বৃত্তটি দৃশ্যমান, তার পেছনে যে আসল এক নম্বর নির্বিঘ্নে কলকাঠি নাড়ছে; তার কথা তো তিনি বলছেন না।
জানলেও অবশ্য বলার উপায় নেই। কারণ যে দেশগুলো এই শত্রুটির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অনিচ্ছুক, তারা ওই ধরনের বক্তব্য পছন্দ করবে না। ওইসব দেশের শাসকরা সবাই পুঁজিবাদের ওপরেই ভর করে আছেন; নাড়াচাড়া দিলে তাদের জন্য মহাবিপদ। আগামীতে আইসোলেশনের জায়গাতে আনতে হবে রেসিপ্রোকেশন- এমন বক্তব্যও পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ সেই দেবে এবং নেবে, মেলাবে মিলিবে। শুনতে ভালো, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অকার্যকর। তা ছাড়া দেবে আর নেবে তো ওই ফেল কড়ি মাখো তেলেরই হেরফের। শেষ পর্যন্ত কেনা-বেচাই। শুরুতে টাইম ম্যাগাজিনের যে বক্তব্যটি আমরা উদ্ধৃত করেছি, সেখানে বরং বাস্তববাদিতা রয়েছে।
বলা হচ্ছে, প্রয়োজন কো-অপারেশন। কিন্তু কো-অপারেশন কী জন্য? টিকা উদ্ভাবনের জন্য? সেখানেও তো দেখা যাচ্ছে মহাফ্যাসাদ। জার্মান কোম্পানি টিকা উদ্ভাবনে এগিয়ে আছে শুনে ট্রাম্প সাহেব প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ওটি তিনি কিনে নেবেন। এর পরে রাশিয়া টিকার একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গেছে প্রচার হওয়াতে অন্যক'টি দেশ একযোগে বলছে, তাদের কাছ থেকে ফর্মুলা চুরির চেষ্টা চলছে। হতাশাগ্রস্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্বেগ বেড়েছে এটা দেখে যে, এই বিপদকালে আমেরিকা, চীন ও রাশিয়া- এই তিন বৃহৎ শক্তির মধ্যে বিরোধটা এমন জায়গাতে গিয়ে পৌঁছেছে, যেমনটা আগে কখনও দেখা যায়নি। বিশ্ব আশঙ্কা করছে, জীবন বাঁচানোর টিকা নিয়েও রাজনীতি চলবে। জনমতের চাপে টিকা হয়তো শেষ পর্যন্ত বিনামূল্যেই বিতরণ করা হবে। কিন্তু বড় দেশগুলোর প্রত্যেকটিই চাইবে এককভাবে কাজটা করতে, যাতে আধিপত্য থাকে, নিজ নিজ রাজনৈতিক প্রভাব বলয়টাকে প্রসারিত করা যায়। মানুষের চরম বিপদ মানুষের এই শত্রুদের ক্ষমতা বাড়াবে। হ্যাঁ, কো-অপারেশন চাই। কো-অপারেশন চাই নতুন এক আন্তর্জাতিকতা সৃষ্টির জন্য, যেটির চরিত্র দোকানদারির হবে না; হবে মানবিক। যার লক্ষ্য সীমিত থাকবে না; প্রসারিত হয়ে রূপ নেবে বৈপ্লবিক। আর সে বিপ্লবটা হবে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার।
অনেকেই বলেন, রাষ্ট্রকে সামাজিক দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা চাই। সেটি কিন্তু কিছুতেই সম্ভব নয়। রাষ্ট্র সমাজের সুবিধাভোগীদের স্বার্থ রক্ষার কাজে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান। তাকে ধর্মের কাহিনি শুনিয়ে লাভ নেই। তাতে সে উল্টো খেপে যেতে পারে। 'জননিরাপত্তা' নিশ্চিত করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তলব করে বসতে পারে। যা দরকার তা হলো, রাষ্ট্রের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। যার অর্থ দাঁড়াবে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে ক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ এবং নাগরিকদের ভেতর অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রত্যেক নাগরিককে সব রকমের নিরাপত্তা দেওয়া। বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রগুলো যদি ওই রকমের হতো, তাহলে করোনাভাইরাসের আক্রমণটাই ঘটত না। অঙ্কুরেই সে মারা পড়ত।
শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্নেষক
মন্তব্য করুন