আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা আছে 'প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র'। গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন অপরিহার্য, নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। নির্বাচন মানেই বিকল্প প্রার্থীকে বেছে নেওয়া। সেই নির্বাচন যেনতেন হলে হবে না; নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। কারণ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে বিরোধ সৃষ্টি হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতায় রূপ নেয়। নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা হওয়ার কথা, বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। বিরোধ হয় কে ক্ষমতায় যাবে, কে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে- এমনকি কে কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে তা নিয়ে বিরোধ হয়। ভিন্ন পথ, ভিন্ন মত, ভিন্ন কাজের পরিকল্পনা রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে থাকে। নির্বাচনের মাধ্যমে এই বিরোধগুলো মীমাংসা হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, নির্বাচন হলো জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতীক; জনগণ যে সকল ক্ষমতার উৎস নির্বাচনের মাধ্যমে তা প্রমাণ করতে হয়।
নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত থাকে ভোটার, প্রার্থী-রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন ও সরকার। এই চার অংশীজন সঠিকভাবে নিজেদের ভূমিকা পালন করলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে। আসন্ন উপনির্বাচন কেমন হবে তা নির্ভর করছে এই চার অংশীদারের দায়িত্ব ও ভূমিকা পালনের ওপর।
গণতন্ত্রের জন্য দরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বই হবে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা। নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হবে তা ওই অনুচ্ছেদে বলা আছে। একই অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, 'নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।' অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে সুস্পষ্ট চারটি দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, '(১) রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান ও আইনানুযায়ী- (ক) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; (খ) সংসদ-সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; (গ) সংসদে নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবেন; এবং (ঘ) রাষ্ট্রপতির পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুত করিবেন।' এই দায়িত্বগুলো পালনের ক্ষেত্রে
নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করবে, এটাই সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষা।
নির্বাচনী কার্যক্রমে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা হলো ফুটবল মাঠের রেফারির মতো। ফুটবল মাঠে কেউ ফাউল বা বাড়াবাড়ি করলে বাঁশি বাজিয়ে খেলা বন্ধ করে রেফারি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। খেলা যেন অহেতুকভাবে বিঘ্নিত না হয়, খেলার বিধিবিধান যেন ঠিক থাকে এবং কেউ যেন সমান সুযোগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য রেফারিকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হয়। ঠিক তেমনিভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম যাতে বিঘ্নিত না হয়, সবাই যেন সমান সুযোগ পায় এবং নির্বাচনী বিধিবিধান কার্যকর করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ হতে হয়। পক্ষপাতদুষ্ট হলে তাদের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভবপর হবে না। নির্বাচন কমিশনকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য নিরপেক্ষ হওয়ার পাশাপাশি যোগ্য ও নির্ভীক হতে হয়। সঠিক ভোটার তালিকা, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।
সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটারদের ভূমিকাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভোটাররা যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেজন্য যথাযথ তথ্য তাদের দিতে হবে। আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থীকে তাদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামার মাধ্যমে কিছু তথ্য দিতে হয়। এই তথ্যগুলো দেওয়ার উদ্দেশ্য ভোটারদের ক্ষমতায়িত করা। ভোটার যাতে তথ্যের ভিত্তিতে জেনেশুনে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। তথ্যগুলো যেন সঠিক হয়; কারণ তথ্য যদি বিভ্রান্তমূলক হয় তাহলে মানুষ ক্ষমতায়িত হওয়ার পরিবর্তে বিভ্রান্ত হবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সব প্রার্থীর তথ্য সংগ্রহ করা এবং তথ্য সঠিক কিনা বা তথ্য গোপন করা হয়েছে কিনা- যাচাই-বাছাই করা।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা যেন সৎ, দক্ষ ও জনকল্যাণে নিবেদিত হন সে বিষয়টি নিশ্চিত করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। প্রার্থীরা অসৎ, দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ ও সমাজের অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হলে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। প্রার্থীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা জরুরি। কেউ যদি আইন ভঙ্গ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের থাকে। তবে ক্ষমতা থাকলেই হবে না, তার প্রয়োগও করতে হবে। রাজনৈতিক দলের সদাচরণ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য খুবই জরুরি। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে সব ধরনের অবাঞ্ছিত আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে। নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী অসদাচরণ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া আছে। নির্বাচন কমিশনকে এই ক্ষমতা নির্মোহভাবে ব্যবহার করতে হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের খাতিরে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে সরকারের সদিচ্ছা। সরকার মানে প্রশাসন, সরকার মানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ না হয়, প্রশাসন যদি সমতা আনয়নের ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর না হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি অসদাচরণ করে বা কারও পক্ষে কাজ করে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। সবচেয়ে যোগ্য, দক্ষ, সৎ ও ক্ষমতাসম্পন্ন নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না, যদি না সরকার চায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যদি নির্বাচন প্রভাবিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়, প্রশাসন যদি পক্ষপাতমূলক আচরণ করে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচনের আগে যাতে সব প্রার্থী সমভাবে সুবিধা পায় এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটে তাও নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব।
আমাদের দেশে বিগত কয়েকটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনগুলোতেও ইভিএম ব্যবহার করা হতে পারে। আমরা যে ইভিএম এখন ব্যবহার করছি এগুলো কেনা হয়েছে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে। এই ইভিএমগুলোতে একটি বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। যেটাকে বলা হয় 'ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল'। ফলে ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা পরবর্তী সময়ে নিরীক্ষার কোনো সুযোগ থাকে না। নির্বাচন কমিশন যা বলে সেটাই মেনে নিতে হয়। উল্লেখ্য, ইভিএম প্রকল্পের কারিগরি ও পরামর্শক কমিটির সুপারিশ অমান্য করে ইভিএমে 'পেপার অডিট ট্রেইল' সুবিধা না রাখার কারণে ওই কমিটির উপদেষ্টা প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী সাব-কমিটির সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি। এগুলো যদি ঠিকঠাক হয় এবং নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করে তাহলে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে। তা না হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা দুরাশা।
আমরা আশাবাদী হতে পারি না। কারণ গত জাতীয় নির্বাচনে আমাদের নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট বলে নিজেকে প্রমাণ করেছে। প্রশাসনও চরমভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। পক্ষপাতদুষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিরোধী দলের অনেক প্রার্থীকে প্রচার-প্রচারণা চালাতে দেওয়া হয়নি। অনেককে হয়রানি করা হয়েছে। এগুলো বিবেচনায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে নির্বাচনকে সহিংসতামুক্ত রাখা দরকার। তা না হলে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)