অস্বীকার করা যাবে না যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সোমবার থেকে বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা হঠাৎ করেই দিয়েছে। কিন্তু তার ফলে পরদিন মঙ্গলবার থেকেই বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। আমরা জেনেছি, বিভিন্ন গুদামে এখনও দেশীয় পেঁয়াজের মজুদই রয়েছে পাঁচ লাখ টনের বেশি। সোমবারের আগে ভারত থেকে ইতোমধ্যে আমদানি হওয়া পেঁয়াজের পরিমাণও বিবেচ্য। সোমবারই বাণিজ্যমন্ত্রী সমকালের কাছে বলেছেন, ইতোমধ্যে বিকল্প বাজার থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পেঁয়াজের আমদানি শুল্ক্ক প্রত্যাহারের দাবি যদিও এনবিআর দেশীয় কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় আগেই নাকচ করেছে, পরিস্থিতি বিবেচনায় সেই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনাও করতে পারে বলে মন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সবদিক থেকে দেখলে, মঙ্গলবার বাজারে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি কৃত্রিম। একদিকে ভোক্তারা আতঙ্ক থেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পেঁয়াজ কিনছে, অন্যদিকে পাইকার ও মজুদদাররা সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সংবাদমাধ্যম সূত্রে আমরা জেনেছি, মঙ্গলবারই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পেঁয়াজের সরবরাহ, আমদানি ও বাজার ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাজার তদারকি ও নজরদারির জন্য জেলা প্রশাসকদেরও দেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। আমরা আশা করতে পারি, এর ফলে গত বছর একই সময়ের মতো দেশে পেঁয়াজের কৃত্রিম বা প্রকৃত সংকট তৈরি হবে না। ভোক্তা ও খুচরা বিক্রেতারাও কান দেবে না গুজবে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে- প্রতিবছরই এভাবে পেঁয়াজ নিয়ে সংকট দেখা দিতেই থাকবে? স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। প্রতি বছর আমাদের পেঁয়াজের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈকি। বিপরীতে প্রতিবছর প্রায় ১২ শতাংশ হারে পেঁয়াজের উৎপাদনও বাড়ছে, আমরা জানি। উৎপাদন ও চাহিদার এই ব্যবধান বুঝে আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া কি খুবই কঠিন। বিশেষত গত মৌসুমে এত কাণ্ডের পরও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কেন আগে থাকতে ব্যবস্থা নিল না, সেটা আমাদের হতাশ করেছে। এটা ঠিক, আমদানির ক্ষেত্রে আমাদের দেশে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। বিদ্যমান বাস্তবতায় দেশটির পেঁয়াজ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের পেঁয়াজের বাজারের পরিস্থিতি তাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি পণ্য নিয়ে আমরা কোনো একটি দেশের ওপর এতটা নির্ভরশীল থাকব কেন? আমাদের মনে আছে, ভারত থেকে গরু 'আমদানি' যখন বন্ধ হয়েছিল, তখনও মাংসের বাজারে সংকটের আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, শাপে বর হয়েছে। গরু উৎপাদনে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছি। আমরা বিশ্বাস করি, পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠা কঠিন হতে পারে না। এ ছাড়া পেঁয়াজের বিকল্প বাজারগুলো থেকে সময় থাকতে আমদানির ব্যবস্থা করা গেলে বাজারে সংকটের শঙ্কা থাকে না। আমরা গভীর হতাশা ও ক্ষোভের সঙ্গে দেখি, প্রত্যেকবারই বিকল্প বাজার থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ভারতের বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর। এই অদূরদর্শিতা পরিহার করতেই হবে। বাজারের লাগাম টানতে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়, সংকটের সময় বিক্রির হার বাড়িয়ে দেওয়াও হয়। কিন্তু তা চাহিদার তুলনায় সামান্য। আমরা দেখতে চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। 'স্পর্শকাতর' পণ্যের ব্যাপারে দূরদর্শী হওয়ার বিকল্প নেই। সরকার বাজার নজরদারির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা সেটাকে নিশ্চয়ই স্বাগত জানাই। কেউ অতি মুনাফার জন্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে কিনা, সেটি অবশ্যই তদারকি করতে হবে। বিশেষত খুচরা ও আড়ত পর্যায়ে এটি দরকার। কেউ যাতে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি না করে, সে ব্যাপারেও প্রয়োজন সচেতনতা ও সতর্কতামূলক কর্মসূচি। কিন্তু বাজার স্বাভাবিক কিংবা স্থিতিশীল রাখতে সরবরাহ যাতে পর্যাপ্ত থাকে, তা আগেভাগেই নিশ্চিত করতে হবে। শেষ মুহূর্তের তাড়াহুড়া পরিস্থিতি কেবল জটিলই করে তোলে।