ভালোমন্দ দুই-ই রয়েছে পুলিশ বাহিনীতে। মানব সমাজের সভ্যতায় ভালোমন্দ দুইয়েরই অবস্থান সমান্তরাল। পুলিশ বাহিনীও এর ব্যতিক্রম নয়। পুলিশ বাহিনীতে যেমন ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ সদস্য রয়েছে আবার সৎ, নিষ্ঠাবান ও মানবিক মূল্যবোধে প্রতিশ্রুতিশীল সদস্যও কম নয়। সৎ ও নিষ্ঠাবানের সংখ্যা অধিক হলেও অধমের দৌরাত্ম্য অনেক বেশি। প্রতিষ্ঠা প্রলুব্ধ এ জগতে অসত্যের দাসত্ব করার অভ্যাস গড়ে ওঠার কারণে ত্যাগ ও ভোগের রাজ্যে একটা সমান্তরাল অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পুলিশ বাহিনীতে সেবা ও ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে কাজ করার সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি। রাষ্ট্রের বিভিন্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টিনন্দন মানবীয় ভূমিকার কথা ভুলে গেলে চলবে না। এই কভিড-১৯ মহামারির সংকটকালে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অসংখ্য পুলিশ সদস্যের প্রাণপ্রদীপ নিভে গেছে। তাদের মহান ত্যাগ আমাদের করেছে গৌরবান্বিত। এ বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই একটি সুন্দর ও সফলকাম জীবনচর্চার প্রতি যত্নবান।
উল্লেখ্য, স্বার্থবুদ্ধিপুষ্ট মানুষের হাতে অস্ত্র যেমন অপর মানুষের জন্য নিরাপদ নয়, কিন্তু স্থিত-প্রাজ্ঞ মানুষ সেই একই অস্ত্র মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করে। পুলিশের ক্ষেত্রেও এটা সমভাবে প্রযোজ্য। পুলিশ নিয়ে অতীতেও অনেক নেতিবাচক কথা শুনেছি।
আমাদের এ উপমহাদেশে ১৮৬১ সালে লর্ড ক্যানিংয়ের শাসনামলে পুলিশ সার্ভিস রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু হয়। ১৮৬১ সালের প্রণীত রেগুলেশন দ্বারা পুলিশ প্রশাসন পরিচালিত হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৮৬১ সালের প্রণীত রেগুলেশন দ্বারাই পুলিশ প্রশাসন এখনও পরিচালিত হচ্ছে। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুলিশের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশের মূলনীতি হচ্ছে শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও প্রগতি। মূলনীতিগুলোর ব্যাপক ব্যাখ্যা রয়েছে। সার কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের নিরাপত্তা বিধানে ভূমিকা রাখা এবং সেইসঙ্গে দেশ ও জাতিকে প্রগতির পথে অগ্রসর হতে সহযোগিতা করাই পুলিশের মূল দায়িত্ব। কোনো কোনো পুলিশ সদস্য নিজেদের মূল দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে উচ্চতর ভোগের ইঙ্গিতে যখন বিপথে পা বাড়ায় তখন ইন্দ্রিয় আসক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। এরূপ ব্যর্থতায় মনে প্রতিহিংসা বাসা বাঁধে। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, কেউ কেউ চেয়ারের প্রাপ্ত শক্তিকে ব্যবহার করে দেহভোগ ও সম্পদ অন্বেষণে। এর বিঘ্ন ঘটলে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। এরা জীবনকে উচ্চতর অবস্থায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয় না। ওসি প্রদীপ ও ডিআইজি মিজান এর চাক্ষুষ উদাহরণ। মানুষ কর্মজীবনে সুকুমারবৃত্তির কথা বিস্মৃত হয়ে সাধারণ প্রাণীর মতো নিম্নতর বৃত্তিকে চরিতার্থ করার অশুভ বাসনা পোষণ করে। বাসনা পূর্তির জন্য দৈহিক ও বৌদ্ধিক শক্তি বিস্তার করে। এতে আপাত সাফল্য অর্জিত হতে পারে, এ সাফল্যে গর্বিতও হতে পারে কিন্তু পরিণামে মহাদুঃখ।
মানুষের কর্মজীবনে দুটি নৈতিক ভাবনা থাকা আবশ্যক। ভাবনা দুটি হচ্ছে ত্যাগ ও সেবা। ত্যাগ কিসের! আত্মকেন্দ্রিক অহংকার বা স্বার্থের ত্যাগ। বিরাট আত্মার অভিব্যক্তি। ত্যাগ হলো প্রাক্‌-মূল্য প্রাথমিক আবশ্যকতা। পরবর্তী মূল্য হলো সেবা, কোনোরূপ ত্যাগ ছাড়া সেবা হয় না। আমি যদি কাউকে সাহায্য করতে চাই, তবে সেই অনুপাতে আমাকে ত্যাগ করতে হবে নিজের স্বার্থ। কর্মে থাকতে হবে যজ্ঞ ভাবনা। কর্মে যাজ্ঞিক চরিত্র হারিয়ে গেলে সে কর্ম দিয়ে কখনও রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণ হতে পারে না। বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীতে যাজ্ঞিক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনেকেই কর্মে সফলতা দেখিয়েছে। জীবনে শুদ্ধতা, কল্যাণ কর্মে নিষ্ঠা এ হচ্ছে কর্মকুশলতা। এই কর্মকুশলতা গড়ে তুলতে চাই সাধনা। এ উদাহরণ পুলিশ বাহিনীতেই আছে।
নিয়ন্ত্রণহীন ইন্দ্রিয় শক্তি অধমতুল্য, পুলিশ বাহিনীতে এ অধম রাজত্ব একদিন বিলুপ্ত হবেই।
phani.sarker@gmail.com

বিষয় : পুলিশের ত্যাগ

মন্তব্য করুন