
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার আওতাধীন দেশে চিনিকলের সংখ্যা ১৫টি। এই চিনিকলগুলোতে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। বাংলাদেশের চিনিকলগুলো বছরে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন চিনি উৎপাদন করে থাকে। মিলভেদে চিনি উৎপাদন খরচ কেজিপ্রতি ওভারহেডসহ ৭৫০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। উৎপাদিত চিনি বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী মিল গেটে ৬০ টাকা প্রতি কেজি ধার্য করার পরও অবিক্রীত রয়েছে। ভালো রিফাইন হয় না বলে চিনি অবিক্রীত থাকে।
বাংলাদেশের যে কয়টি বেসরকারি সুগার রিফাইনারি রয়েছে সেগুলো দেশের চাহিদা পূরণ করে এক্সপোর্টও করতে পারবে। গত ২৪ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের আওতাধীন শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাবদ ২১০ কোটি টাকা অপরিশোধিত রয়েছে। আখচাষিদেরও ১৬১ কোটি টাকা বকেয়া রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০ অনুযায়ী শুধু ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন লোকসান করেছে ৫১৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। সেটা বাড়তে বাড়তে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৯৮২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বকেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সুগার মিলে সরকারের প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে।
দেশে বছরে প্রায় ১৮ থেকে ২০ লাখ টন চিনি আমদানি হলেও করপোরেশন তাদের উৎপাদিত মাত্র ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন চিনিও বাজারে বিক্রি করতে পারছে না চিনির মান ভালো না হওয়ায়। এই চিনি গ্রাহকরা কিনতে চান না। বেসরকারি উদ্যোগে ৪টি চিনি রিফাইনারি মিল আমদানিকৃত চিনির বাইরে দেশের চাহিদা পূরণ করে এবং বিদেশেও রপ্তানি করে।
বাস্তবিক দিক থেকে বাংলাদেশের চিনিকলগুলো বছরে মাত্র ৪ থেকে ৫ মাস চালু থাকে। আর বাকি ৭ মাসই শ্রমিক-কর্মচারীরা কোনো কর্ম ছাড়াই বেতন-ভাতা গ্রহণ করে থাকে। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থের ঘাটতি হচ্ছে। বছরের পর বছর ঋণের বোঝা বড় হচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস লি. ১৯৫৮-৫৯ সালে স্থাপিত হয়। ওই মিলের ট্রেনিং কমপ্লেক্স, হাই স্কুল, ক্লাব, মেডিকেল সেন্টার, ফ্যামিলি কোয়ার্টার, সিঙ্গেল কোয়ার্টার ও মিল এরিয়ার পরিমাণ ২৮৮৮.৫৯ একর। এই জমি ছাড়াও মিলজোন এলাকায় আখ চাষের জন্য প্রায় ৪৮ হাজার একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার একর জমিতে প্রতি বছর আখ চাষ করা হয়। আর বাকি দুই-তৃতীয়াংশ জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় থেকে যায়। এভাবে দেশের ১৫টি চিনিকলেরই হাজার হাজার একর জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। চিনির মিল বন্ধ করে ফলের চাষ করলে প্রতি বছর সরকারের ক্ষতি কমবে ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ প্রতি বছর বিদেশ থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ফল আমদানি করে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম আঙুর, বেদানা, আপেল, কমলা, মোসাম্বি, নাশপাতি, হানিডিউ মিলান, রেড মিলান, সাম্মাম, স্ট্রবেরি, ড্রাগন ও খেজুর। এর ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চলে যাচ্ছে। পরিত্যক্ত জমিতে ফল চাষ করা গেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা যাবে। এজন্য দরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতা এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উদ্যোগী করে তোলা। এগুলো করা গেলে এসব জমিতে ফলের চাষ করে লোকসানের পরিবর্তে লাভবান হওয়া যাবে।
চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সুগার মিল বন্ধ করে ও সরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে ঠাকুরগাঁও সুগার মিলের আখ চাষাবাদের পুরো জায়গায় বিদেশি ফল চাষাবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এর ফলে দেশের অর্থ দেশেই থাকবে। বিদেশ থেকে ফল আমদানি করতে গিয়ে যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্থের অপচয় হয় তা রোধ হবে।
এ ব্যাপারে সঠিক দিকনির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ দেশের কৃষিতে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে। এই উদ্যোগ নেওয়া হলে অনেকেই এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন বলে আমার বিশ্বাস।
সাবেক সংসদ সদস্য; চেয়ারম্যান
পারটেক্স গ্রুপ
মন্তব্য করুন