- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- বিশ্বসভায় বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা
অর্জন
বিশ্বসভায় বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে জাতিসংঘের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ও প্রকল্প পরিষেবাগুলোর জন্য জাতিসংঘের অফিসের (ইউএনওপিএস) নির্বাহী বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ৫৪ সদস্যের জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) এ সংস্থাগুলোর নির্বাচন হয়। নির্বাচনে বাংলাদেশ ৫৪ ভোটের মধ্যে ৫৩ ভোট পায়। একটি সদস্য ভোটদানে বিরত ছিল। বাংলাদেশ ২০২১-২৩ মেয়াদে এই নির্বাহী বোর্ডে সদস্যের দায়িত্ব পালন করবে।
সাম্প্রতিক কালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের এমন গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ অনন্য কয়েকটি অর্জন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে নিঃসন্দেহে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে দেশ হিসেবে সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে গত ৩১ আগস্ট থেকে সর্বোচ্চ স্থান অর্জন আমাদের দেশের সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মেধা এবং আন্তরিক কার্যক্রমের প্রকৃত পেশাদারিত্বের পরিচায়ক। বর্তমানে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য সর্বোচ্চসংখ্যক শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে প্রথম। বাংলাদেশের ছয় হাজার ৪৭৭ জন পুরুষ ও ২৫৫ জন নারী মিলিয়ে মোট ছয় হাজার ৭৩১ জন বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত। এ ছাড়া বাংলাদেশি একজন সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মো. মাঈন উল্লাহ চৌধুরী দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার নির্বাচিত হয়েছেন।
শুধু তাই নয়, দু'দুবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মতো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে অস্থায়ী সদস্যপদ অর্জনে যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব বাংলাদেশকে ভোট দিতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আগ্রহী করেছে, তার মধ্যে শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের কার্যকর ও তাৎপর্যপূর্ণ অসামান্য অবদান উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ বর্তমানে ইউনিসেফ ও ইউএন উইমেনের নির্বাহী বোর্ডেরও সদস্য। এ ছাড়া জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা বর্তমানে ইউনিসেফ নির্বাহী বোর্ডের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশ ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। এতে ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। কাউন্সিলের নির্বাচনে বাংলাদেশ ১৭৮টি ভোট পেয়েছিল। বাংলাদেশ এর আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের তিনটি মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছিল। আর জাতিসংঘের মতো এমন সর্বজনীন বিশ্ব সংস্থায় এসব আকাশচুম্বী সাফল্য বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের এসেছে বর্তমান দিনবদলের সরকারের হাত ধরে। আর এ কথা আজ কে না জানে, এসব গগনচুম্বী সাফল্যের প্রধান স্থপতি বর্তমান সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এর কয়েক দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের স্থপতি, প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই ভাষণটি ছিল গোটা বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত, অধিকারহারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ভাষণ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও সাহসী পদক্ষেপ।
জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু তার প্রথম বক্তৃতায় বিশ্বশান্তির সঙ্গে ন্যায়ের সমন্বয়ের প্রতি তাগিদ দেন। তিনি বলেন, 'আমরা বিশ্বাস করি যে, সমবেত উন্নয়নশীল দেশসমূহ শান্তির স্বার্থকে দৃঢ় সমর্থন করে। জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা এবং শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিশ্বের বিপুল সংখ্যাগুরু জনগণের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কথা তাঁহারা প্রকাশ করিয়াছেন। মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি অত্যন্ত জরুরি এবং তাহা সমগ্র বিশ্বের নর-নারীর গভীর আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটাইবে। এবং ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত শান্তিই দীর্ঘস্থায়ী হইতে পারে।'
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন তার বক্তব্য শেষ করেন মর্মস্পর্শী মূল্যবান কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে, যা আজ এবং আগামী বিশ্বের শান্তি ও সম্প্রতির জন্য একান্ত অপরিহার্য বলে প্রতীয়মান। বঙ্গবন্ধু বলেন- 'জনাব সভাপতি, মানুষের অজয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতে চাই। আমাদের মতো যেইসব দেশ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, এই বিশ্বাস তাহাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের লক্ষ্য স্বনির্ভরতা। আমাদের পথ হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যার শরিকানা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হ্রাস করিবে এবং আমাদের কর্মকাণ্ডকেও সহজতর করিবে, ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই। নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটিতেছে। আমাদের নিজেদের শক্তির ওপর আমাদের বিশ্বাস রাখিতে হইবে। আর লক্ষ্য পূরণ এবং সুন্দর ভাবীকালের জন্য আমাদের নিজেদেরকে গড়িয়া তুলিবার জন্য জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আগাইয়া যাইব।'
জাতির পিতার স্বপ্নপূরণে তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুউচ্চ মর্যাদার ইমারত নির্মাণে দৃঢ় পদক্ষেপে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বদরবারে নিজেকে আরও অনেক বেশি মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের এ অগ্রযাত্রা গোটা বিশ্ব আজ তীক্ষষ্ট দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে। এ অর্জনের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণের মেধা-মনন, শ্রমজনিত বিন্দু বিন্দু ঘাম আর প্রদীপ্ত আলোকশিখার মতো প্রাণস্পন্দন, একনিষ্ঠ সাধনা, বাসনা; সর্বোপরি শেখ হাসিনার সুউচ্চ হিমালয়সম অটল অবিচল নেতৃত্ব। বাঙালি হিসেবে আজ অহঙ্কারের মাত্রা আরও এক ধাপ যোগ করতেই পারি আমরা।
অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
মন্তব্য করুন