
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই মুহূর্তে শরতের স্নিগ্ধ রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের মতো নির্বাচনের আমেজ শুরু হয়েছে। তবে সেই আমেজ কতটা স্নিগ্ধ বলা বোধ করি দুরূহ। এবারও দুটি প্রধান দলের চূড়ান্ত মনোনীত প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ডেমোক্রেটিক দল থেকে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ আর. বাইডেন (জো বাইডেন) এবং রিপাবলিকান দল থেকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ডেমোক্রেটিক দল থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রথমবারের মতো একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে সিনেটর কমলা দেবী হ্যারিস চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছেন। মাতৃসূত্রে তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। রিপাবলিকান দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইকেল আর. পেন্স। বিশ্নেষকদের মতে, ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একটি অসাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিকতা ছিল না। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক আবাসন ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতি। ২০১৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে ট্রাম্পের চূড়ান্ত মনোনয়ন থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া অবধি ব্যাপারগুলো কাকতালীয় মনে হয়েছিল। অনেকে সেই সময় ধরেই নিয়েছিল যে, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে জিতেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৬ সালের নির্বাচনের এরূপ ফলাফলের ব্যাখ্যা ছিল অনেকটা এরকম- রাজনৈতিক বলয় কিংবা প্রথাগত রাজনীতিবিদদের প্রতি জনসাধারণ ভয়ংকররূপে বীতশ্রদ্ধ। ভোট পরিসংখ্যানে দেখা গেল নিম্ন-মধ্যম এবং মধ্যম আয়ের ব্যবসায়ী জনগোষ্ঠী একচেটিয়া ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে।
২০১৬ সালের নির্বাচনে অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক না হলেও জনসাধারণ ওবামা প্রশাসনের আয়কর নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিল না। বিশেষ করে বলা যেতে পারে, নিম্ন-মধ্যম ও মধ্যম আয়ের ব্যবসায়ী ও কর্মজীবী সম্প্রদায়। এছাড়া পররাষ্ট্র বিষয়ে ইরাক, আফগানিস্তান এবং লিবিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ফলে যে পরিমাণ বাজেট এবং বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছিল সেই বিষয়গুলোই ২০১৬ সালের নির্বাচনে গুরুত্ব পেয়েছিল। আমেরিকার নাগরিকরা মনে করেছিল যে, এমন একজন প্রেসিডেন্ট প্রয়োজন যিনি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবেন এবং কোনো প্রকার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন না। তার প্রতিফলন আমরা দেখেছি ২০১৬ সালের নির্বাচনে।
নিরপেক্ষভাবে দেখলে দেখা যাবে- প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার নির্বাচনী ইশতেহারে যে বিষয়গুলো নিয়ে জোর গলায় প্রতিবাদ করেছেন এবং সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি সেগুলো করেও দেখিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসকরণ। ব্যাপক হারে ব্যক্তিগত ও করপোরেট আয়কর ছাড়, যার লক্ষ্য ছিল ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি। পুনরায় যুদ্ধে না জড়ানোর লক্ষ্যে উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া, ইরান, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধাপে ধাপে সৈন্য প্রত্যাহার। মেক্সিকান সীমান্তে দেওয়াল করা একটি বিতর্কিত বিষয় সত্ত্বেও ট্রাম্প প্রশাসন সেই কাজটাও শুরু করেছে। মোটা দাগে যে দুটি বিষয়ে আকাঙ্ক্ষিত সাফল্য অদ্যাবধি সুদূরপরাহত তা হলো- স্বাস্থ্য বীমা নিশ্চিতকরণ এবং অভিবাসী আইন সংস্করণ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি প্রশাসনের আমলেই যুদ্ধ ছিল নিশ্চিত বিষয়। কিন্তু মার্কিন নাগরিকরা যুদ্ধ নিয়ে উদাসীন। অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান নিয়ে সাধারণ মানুষ বেশি আগ্রহী। এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, যে কয়েকটি যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অংশ নিয়েছে, তার ফলাফল খুব সুখপ্রদ নয়। দেখা গেছে, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দেশটি একটি চরম অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হয়েছে এবং এর তীব্র নেতিবাচক প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর পড়েছে। গত চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা ছিল। যদিও কর্মসংস্থান ছিল গত বিশ বছরের তুলনায় সর্বনিম্ন। ট্রাম্প প্রশাসন বলতে চাইছে- কভিড-১৯ কর্মসংস্থানে স্বল্পকালীন অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি করলেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে না।
আসন্ন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট শিবির অভিবাসন আইন সংস্করণ, স্বাস্থ্য বীমা জাতীয়করণ, পুলিশ আইন সংস্করণ, মহামারি কভিড-১৯ টেকসইভাবে নিয়ন্ত্রণসহ ট্রাম্প প্রশাসনের গৃহীত নানাবিধ আলোচিত এবং সমালোচিত পদক্ষেপের পুনঃসংস্করণ নিয়ে দীর্ঘ নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। ট্রাম্প রাজনীতিবিদ নন। তিনি এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যেগুলো আগে কোনো প্রেসিডেন্ট নেননি। যেমন- ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি অনেকাংশে হ্রাসকরণ, জেরুজালেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপন, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে না জড়ানো এবং সম্প্রতি ইসরায়েল ও আরব আমিরাতের মধ্যকার চুক্তি। ডেমোক্রেটিক দল কঠোরভাবে সমালোচনা করেছে এবং তারা নির্বাচনে জয়ী হলে ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া পদক্ষেপগুলো কতটুকু কার্যকর থাকবে সেটা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল।
করোনা পরিস্থিতিতে এবারে ভোটাররা দ্বিধাগ্রস্ত; কেন্দ্রে গিয়ে, নাকি ডাক মারফত ভোট দেবেন। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে- ৫০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে আগ্রহী, ৪৯ শতাংশ ডাক মারফত। যদিও ট্রাম্প জোরালোভাবে ডাক মারফত ভোটের কড়া সমালোচনা করছেন। সম্প্রতি 'পিউ রিসার্চ সেন্টার' একটি জরিপে দেখিয়েছে বাইডেন শুধু যে সূচকটিতে এগিয়ে আছেন সেটা হলো 'তিনি ট্রাম্প নন'। অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ নিবন্ধিত ভোটার মনে করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বদল দরকার।
সাধারণত নির্বাচনে 'ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর' অর্থাৎ যিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন, তার দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা একটু বেশি থাকে। ইতিহাসে দেখা যায় ভয়ানক কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে প্রায় প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তবে কভিড-১৯ মহামারির দরুন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক প্রাণহানি হয়েছে, কমবেশি দুই লাখ। সর্বোপরি এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসেনি। ফলে করোনা মহামারি হতে পারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরাজয়ের একমাত্র উল্লেখযোগ্য কারণ।
আরেকটি বিষয়- যুক্তরাষ্ট্রে শুধু জনপ্রিয়তা দিয়ে কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না। সেখানে 'ইলেক্টোরাল কলেজ' নামক একটি ব্যবস্থা আছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন প্রায় সব নির্বাচনী সমীক্ষায় এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও নির্বাচিত হতে পারেননি। ভোটাররা তাকে বেশি ভোট দেওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছেন 'ইলেক্টোরাল কলেজ' সংখ্যায় এগিয়ে থাকার কারণে। সেই আলোকে জরিপগুলো কতটা নিয়ামক ও নির্ধারক সেটা পর্যালোচনার বিষয়। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে জরিপে দেখা গেছে, জো বাইডেন ৭ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে। কিন্তু সেটা ইলেক্টোরাল কলেজ অর্জন করতে কতটা সহায়ক হবে তা বুঝতে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
গোটা বিশ্বই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে আগ্রহ ও কৌতূহলভরে তাকিয়ে থাকে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। এর নীতি ও প্রশাসনের প্রভাব বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থায় কতদিন যুক্তরাষ্ট্র পরম ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি গবেষক
rezmsba@gmail.com
মন্তব্য করুন