জনস্বাস্থ্যে অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ুর্বেদি চিকিৎসা প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৫.২৬ জন। চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৪ শতাংশ মেটাতে হয় রোগীকেই। যার ধাক্কা সামলাতে গিয়ে প্রতি বছর ৪০ লাখ মানুষ নতুন করে নেমে আসেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। অথচ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সব নাগরিকের জন্য চাই স্বাস্থ্যসেবার অভিগম্যতা। আর এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রিফ্লেক্সোলজির মতো সহায়ক স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি। এবারই দেশে প্রথমবারের মতো ২১ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর উদযাপিত হয়েছে 'ওয়ার্ল্ড রিফ্লেক্সোলজি উইক'।
কোনো ওষুধ, অস্ত্রোপচার বা যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য ব্যবহূত একটি সুপ্রাচীন কার্যকর সহায়ক চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে রিফ্লেক্সোলজি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত। রিফ্লেক্সোলজির তত্ত্ব অনুযায়ী, দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং গ্রন্থিগুলো স্নায়ুর মাধ্যমে হাত ও পায়ের নির্দিষ্ট কিছু অংশের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এই অংশগুলোতে ভোঁতা কাঠি বা আঙুল দিয়ে নির্দিষ্ট নিয়মে চাপ প্রয়োগ করলে তা শরীরের নিজস্ব আরোগ্য প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। রিফ্লেক্সোলজি তার কাজের ক্ষেত্রে শরীরের বাইরের কোনো কিছুকে প্রভাবক হিসেবে ব্যবহার করে না। এ পদ্ধতিতে শরীরের নিজস্ব আরোগ্য শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এবং গ্রন্থির দুর্বলতা বা সমস্যাগুলোকে দূর করা হয়; যার ফলে সংশ্নিষ্ট অসুখটিও সেরে যায়।
রিফ্লেক্সোলজির উৎপত্তি এবং বিকাশের প্রামাণ্য ইতিহাস কমপক্ষে ৪ হাজার ৩৫০ বছরের। গত ৩০০ বছরে রিফ্লেক্সোলজির চর্চা বিকশিত হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের তিনটি শাখাকে কেন্দ্র করে। এগুলো হলো নিউরোলজি, ফিজিওলজি ও সাইকোলজি। গত শতকে
১৯০৪, ১৯৩২ ও ১৯৬৩ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী গবেষণাগুলো সমৃদ্ধ করেছে রিফ্লেক্সোলজি চর্চার ধারাকে।
একটি সহায়ক স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি হিসেবে রিফ্লেক্সোলজি যে কোনো রোগে কার্যকর ভূমিকা রাখে, যদিও এর কার্যকারিতার মাত্রা সব ক্ষেত্রে সমান নয়। রিফ্লেক্সোলজি প্রয়োগে আরোগ্যের সফলতা নির্ভর করে চারটি বিষয়ের ওপর। এক, দেহের কোনো কোনো অঙ্গ-গ্রন্থির দুর্বলতার কারণে সমস্যাটির সৃষ্টি হয়েছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা; দুই, নিয়মিত (সর্বোচ্চ ফল লাভের জন্য ৬ ঘণ্টা পরপর প্রতিদিন ৩ বার) এবং সঠিকভাবে রিফ্লেক্সোলজি থেরাপি নেওয়া; তিন, দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান ঠিক রাখা এবং চার, জীবনাচরণের (দৃষ্টিভঙ্গি, খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক কার্যকলাপ, ঘুম ইত্যাদি) যেসব অসংলগ্নতার কারণে সংশ্নিষ্ট অঙ্গ-গ্রন্থিগুলো দুর্বল হয়ে সমস্যাটির সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো বোঝা এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা। মনে রাখতে হবে, জীবনাচরণের এই পরিবর্তন স্থায়ী না হলে সমস্যাটি ফিরে আসতে পারে। নির্দিষ্ট রোগটির প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও এই থেরাপি গ্রহণকারী বাড়তি কিছু সুফল পেয়ে থাকেন। যেমন এর ফলে বেড়ে যায় কিডনির কর্মক্ষমতা, দেহের রক্ত প্রবাহ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও কর্মশক্তি এবং কমে যায় মানসিক চাপ, অবসাদ ও বিষণ্ণতা। এ ছাড়া রিফ্লেক্সোলজির ব্যবহারে ওজনের ভারসাম্য ঠিক থাকে, স্নায়ুতন্ত্র সজীব থাকে, ভালো ঘুম হয় ও বার্ধক্য বিলম্বিত হয়। ক্রমবর্ধমান চিকিৎসা ব্যয়, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর সামর্থ্যের অতিরিক্ত চাপ ও ওষুধের অতি ব্যবহার এবং অপব্যবহারজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি বাংলাদেশে রিফ্লেক্সোলজি চর্চার প্রয়োজনীয়তাকে ক্রমেই অনস্বীকার্য করে তুলছে। বেশ কিছু কারণে রিফ্লেক্সোলজি আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। এক, এ পদ্ধতি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। দুই, শুধু সাধারণ নয়, জটিল দুরারোগ্য রোগেও কার্যকর। তিন, আদৌ ব্যয়বহুল নয়, খুব সহজেই শিখে নিজের ওপর নিজে প্রয়োগ করা যায়। চার, রোগ লক্ষণ দেখা দেওয়ারও আগে নিজেই তার সম্ভাবনা শনাক্ত করে প্রতিরোধ করা যায়। পাঁচ, অন্য যে কোনো চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি এ থেরাপি করা যায় এবং ছয়, শিশু থেকে শুরু করে যে কোনো বয়সের যে কোনো ব্যক্তির ওপর এ থেরাপি প্রয়োগ করা যায়।

  বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হারমনি ট্রাস্ট-এ কর্মরত
ceo.harmony19@gmail.com