সমাজের চেহারায় একটু-আধটু বেশি-কম থাকলেও সবখানেই পুরুষের চেহারা-চরিত্র মোটাদাগে 'অভিন্ন'। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ পুরুষটিও সংসারের গণ্ডিতে ততটাই 'সবল', যতটা সবলতা নারীকে কাবু ও বশে রাখার পক্ষে যথেষ্ট। 'দুর্বল' নারীকে নির্যাতনের ক্ষেত্র, সম্ভোগের উপকরণ ভাবার প্রশ্নে তাই প্রতিষ্ঠা বা পিছিয়ে পড়া আদৌ বিষয় নয়, গলদ চিন্তা-চেতনায়। ক্ষমতা মানুষকে দুর্বিনীত করে, একচ্ছত্র ক্ষমতায় সে কাণ্ডজ্ঞান হারায়। তাই ধরাকে সরা জ্ঞান কোনো আসমানি বস্তু নয়, ক্ষমতায়িত মানুষের মগজে উৎপন্ন হয় এই দাম্ভিকতা। গায়ে-গতরে দশাসই হোক বা না হোক, চিন্তা-চেতনার স্থূলতা পুরুষকে তাই সব সময়ের শিকারি করে তুলেছে, আর তার সহজ ও হাতের নাগালের শিকার নারী ও শিশু। সব দিক থেকে 'দায়মুক্তি' এই শিকারের মহিমাকে 'কালজয়ী' করে ছেড়েছে।
বৈশ্বিক করোনা অতিমারির জেরে লকডাউন ও অন্যান্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থায় চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি-রাহাজানি কমলেও তাই পুরুষের 'পৌরুষ' কমে না, বরং উল্টো ঊর্ধ্বমুখী এর গ্রাফ। এক হিসাবে, করোনাকালে বিশ্বব্যাপী নারী নির্যাতন বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।
অর্থাৎ পুরুষ সদাসর্বদা তেজীয়ান; দুঃসময়ও তাকে কুপোকাত করতে পারে না। মহামারির মতো মহাবিপদও তার চেতনায় ঘা দিতে অক্ষম। করোনায় প্রমাণিত, গোটা মানবসমাজের দুর্দিনও পুরুষের 'পুরুষালি' ফলানোর উপযুক্ত দিন। এই 'দিন' এক দিনে তৈরি হয়নি।
২০১৩ সালে বাংলাদেশসহ নয়টি দেশের ১০ হাজার পুরুষের ওপর একটি জরিপ করেছিল জাতিসংঘ। তাতে দেখা যায়, এসব দেশের এক-চতুর্থাংশ পুরুষ শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্ত্রীর সম্মতির এতটুকু ধার ধারে না। এই মানসিকতার রসদ কি তারা সমাজ-সংসার-রাষ্ট্র থেকেই পায়নি? স্বামীর মর্জিমাফিক স্ত্রী চলবে- এমন ধারণা সব সমাজেই কমবেশি পোক্ত। স্ত্রীর মন-মর্জির কদর করা পুরুষকে তাই 'স্ত্রৈণ' বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং নারী নির্যাতন না হওয়াই বরং অস্বাভাবিক, যখন পৌরুষের সামাজিক প্রতিশব্দ 'নিপীড়ন' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত!
ম্যারিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্যই করা হয় না বিশ্বের ৫৮ শতাংশ দেশে (ইউএন উইমেনের প্রতিবেদন, ২০১৯)। পুরুষরা কোন দুঃখে নিজেদের অপরাধী ঠাওরাবে। ঘরে নারীর ওপর চড়াও হওয়ার, খবরদারি ফলানো থেকে শুরু করে বল প্রয়োগের অস্ত্র আইনিভাবেই তো পুরুষের হাতে। বিবাহিত পুরুষ যা শেখে, বিয়ের আগে যুবসমাজেরও শিক্ষাক্ষেত্র তো এই সমাজ, এই রাষ্ট্র। এমন নয়, বিয়ের পর পুরুষ নিপীড়ক হয়ে ওঠে। তাই বহু ধর্ষণের ঘটনায় আমরা অভিযুক্তদের দু-চারটা চড়-থাপ্পড় মেরে মীমাংসার চেষ্টায় তৎপর দেখি সমাজপতিদের মধ্যে, এমনকি উল্টো ভুক্তভোগী নারীকে খারাপ 'মেয়েমানুষ' দাগিয়ে দেওয়ার উদাহরণও ভূরি ভূরি। ধামাচাপা দেওয়ার নজির অসংখ্য।
সুতরাং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, সিলেটের এমসি কলেজ, লক্ষ্মীপুর, গোপালগঞ্জ- দেশের সব জেলায়, সব জনপদে ধর্ষক-নিপীড়কদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকাই দস্তুর। টাকা, মাদক, ক্ষমতার দম্ভ বশীভূত 'ব্যবস্থা', এমনকি অস্ত্রশস্ত্রের সহজ জোগান- এত এত রাজসিক আয়োজনে তারা দাপিয়ে বেড়াবে না তো কি যদু-মধুরা বুক চিতিয়ে হাঁটবে। তাদের দাপাদাপির ভয়ে দুয়ার এঁটে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা সহজ, কিন্তু প্রতিবাদ করার বহু পুরস্কারের সাক্ষীও তো বাংলাদেশ।
কিশোরী ভাগ্নিকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় রাজশাহীর বাঘার নাজমুল হোসেনকে (৩০) প্রাণ দিতে হয়েছে বেঘোরে। নাটোরের গুরুদাসপুরে শিশুকন্যাকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় মার খেয়েছেন বাবা। রুখে দাঁড়ানোয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক মাকে জুতাপেটা করেন এক বঙ্গপুঙ্গব। সব ঘটনাই চলতি বছরের।
এমন ত্রাস উপদ্রুত আতঙ্কিত জনপদে মানুষ তাই মুখ খুলতে সাহস পায় না, ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ানোর ভরসা পায় না। কারণ, তার 'ভরসা' হওয়ার, 'সাহস' দেওয়ার কেউ নেই, কিছু নেই। তাই বলে এই না পারার মর্মবেদনা, অনুশোচনার গরলও কি ক্রিয়াশীল থাকবে না ভেতরে-মননে?
এই কথাটিও আরেক দফায় প্রমাণিত- নিপীড়িতের জন্য নিপীড়িতই রয়েছে শুধু; অর্থাৎ জনগণের জন্য জনগণ ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ নেই। একাত্তরেও আমাদের কিছু ছিল না- না অস্ত্র, না প্রশিক্ষিত বাহিনী। তবু জয়ের রাজটিকা আঁকা হয়েছিল আমাদের কপালেই। রাজনীতির বলে বলীয়ান, ক্ষমতার দাপটে দাম্ভিক, 'দায়মুক্তি'র আশকারায় দোর্দণ্ড নিপীড়কের-ধর্ষকের অবস্থা এমন বাহুবলী, সত্য। কিন্তু মানবিক গুণ না থাকলে যোদ্ধা হওয়া যায় না। যা করলে মনুষ্যত্বের অবমাননা হয়, মানবতার পদদলন হয়, যা করলে মানুষকে আর মানুষ হিসেবে চেনা যায় না; তার প্রতি ঘৃণা, ধিক্কারই আমাদের শক্তি; মানবীয় বোধই আমাদের অস্ত্র। এই শক্তি এই অস্ত্র রণাঙ্গনেও সমান কার্যকর। এটাই ভরসার ফিনিক্স পাখি। সুতরাং পথে নামতে কেন দেরি?
সাংবাদিক
hello.hasanimam@gmail.com